সাত মাস ধরে গাজায় আগ্রাসী অভিযান পরিচালনা করছে ইসরায়েলি বাহিনী। তাদের এই আগ্রাসী অভিযানে গাজার ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ শহীদ হয়েছেন। আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন প্রায় এক লাখ মানুষ। আহত ও নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
সম্প্রতি জাতিসংঘ এক প্রতিবেদনে বলেছে, ইসরায়েলি আগ্রাসনে গাজায় ১৫ হাজারের বেশি শিশু নিহত হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো দেশের আগ্রাসনে এত শিশু মারা যাওয়ার ঘটনা সত্যিই বিরল।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনী গাজার হাসপাতাল ও বিদ্যাপিঠে হামলা চালিয়ে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। সেখানে আর কোনো হাসপাতাল ও বিদ্যালয়ের চিহ্নও নেই। আহত রোগীরা ভুগছেন কিন্তু তাদের সুস্থ করে তোলার জন্য কোনো হাসপাতাল নেই। ইসরায়েল নিদারুণ মানবিক বিপর্যয়ে ফেলেছে ফিলিস্তিনি মুসলিমদের।
ফিলিস্তিনিদের মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার জন্য যা করা দরকার, ঠিক তাই করছে ইসরায়েল। বড় বড় দালান কোঠায় একের পর এক বোমা ফেলে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে ইসরায়েল। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ধ্বংসস্তূপের কংক্রিট সরিয়ে ফেলতেও ১৪ বছরের বেশি সময় লাগবে।
কথা হচ্ছে, গাজায় বোমের পর বোম ফেলে কি ইসরায়েল অনেক বেশি লাভবান হচ্ছে? সাত অক্টোবর থেকে ২২৯ দিনের আগ্রাসনে ইসরায়েল গাজায় লাখের বেশি বোমা ফেলেছে। এই বোমা ফেলতে গিয়ে ইসরায়েলের ক্ষতি হয়েছে ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। মিডেল ইস্ট মনিটরের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
রয়টার্স ও সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনে আগ্রাসন চালানোর আগে ইসরায়েল জানিয়েছিল, ২০২৩ সালে তাদের জিডিপি ৩ শতাংশের উপর গ্রোথ থাকবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, গ্রোথ হওয়া তো দূরের কথা, নেগেটিভ মার্ক যুক্ত হয়েছে তাদের জিডিপিতে।
যুদ্ধ চালাতে দেশটির প্রতিদিন অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে ২৬০ মিলিয়ন ডলার। যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে দেশটির যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা রিজার্ভের ২০ শতাংশ (অর্থাৎ ৪৫ বিলিয়ন ডলার) খরচ করার অনুমোদন চেয়েছে। দেশটির অর্থনীতি দুর্বল হওয়ার পাশাপাশি ইন্টারন্যাশনাল রেটিং এজেন্সিতেও ইসরায়েল পয়েন্ট হারিয়েছে। সেখানে আগে দেশটির পয়েন্ট ছিল এ প্লাস। আগ্রাসন চালানোর পর পয়েন্ট দাঁড়িয়েছে এএ মাইনাস। এর অর্থ হচ্ছে ইসরায়েলে বিনিয়োগ করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
রয়াটর্সের অন্য একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩ লাখ ৬০ হাজার রিজার্ভ ফোর্স নিয়োগ করেছে ইসরায়েল। রিজার্ভ ফোর্সের সেনারা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে বিভিন্ন কাজে যুক্ত ছিল। এছাড়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষকে তাদের বাসস্থান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই জন্য ইসরায়েলের অনেক ব্যবসাই মুখ থুবড়ে পড়েছে। দেশটির অনেক রেস্টুরেন্ট ও দোকান এখন খা খা করে। কেনার লোক নেই। দেশটির কৃষি জমি খালি পড়ে আছে। কাজ করার মতো মানুষ পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক প্রতিষ্ঠান হামাসের আক্রমণের ভয়ে তাদের কর্মীদের কাজে আসার কথা বলতে পারছে না।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংক অফ ইসরায়েল জানিয়েছে, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধে দেশটির অর্থনীতিকে স্তিমিত করে দিবে। সেই সাথে দেশের বাজেট ঘাটতি অনেক গুণ বাড়িয়ে দিবে।
আইএলও এক প্রতিবেদনে বলেছে, ইসরায়েল আগ্রাসন শুরু করার পর গাজা ও পশ্চিমতীরের অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছে। শুধু গাজার মানুষ কাজ হারিয়েছে ৬১ শতাংশ। আর পশ্চিমতীরে কাজ হারিয়েছে ২৪ শতাংশ কর্মজীবী মানুষ।
এদিকে আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্মী স্বল্পতার কারণে ইসরায়েলের ৮০ শতাংশ প্রজেক্ট স্থবির হয়ে পড়েছে।
১৯৯৫ সাল থেকে ট্যুরিজম সেক্টরে ইসরায়েল প্রতি বছর প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করে আসছিল। ২০১৯ সালে সেটা বেড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরের বছর করোনার কারণে কমে ২ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। কিন্তু ইসরায়েল আগ্রাসন চলানোর পর থেকে পর্যটকের সংখ্যা অনেক কমে গেছে।
টিআরটি ওয়ার্ল্ডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনে আগ্রাসন চালানোর পর বেশিরভাগ পর্যটক তাদের ভ্রমণ বাতিল করেছে। এয়ারলাইন্সগুলো তাদের ফ্লাইট বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে। ইসরায়েলে আসা লোকের সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে। শুধু ইসরায়েল ছাড়ার সংখ্যা বেড়েছে।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যাদের অন্য দেশে যাওয়ার ন্যূনতম সুযোগ ছিল, তারা সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে। এমন লোকের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। ৫ লাখের বেশি ইসরায়েলে বসবাসকারী অন্য দেশে চলে গেছে। এ জন্য টালমাটাল অবস্থা ইসরায়েলের অর্থনীতির। ইসরায়েল গাজায় বোমা ফেলছে ঠিকই কিন্তু আদতে তাদেরই অর্থনীতির মুখ থুবড়ে পড়ছে।