ভারত শাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহতের পর চরম অবনতি ঘটেছে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক। ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় গুজরাটে সম্প্রতি ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ শনাক্তকরণ অভিযানে রাজ্য পুলিশ এখন পর্যন্ত সাড়ে ছয় হাজারের বেশি মানুষকে আটক করেছে, যাদের বেশিরভাগই ভারতীয় মুসলমান।
সোমবার (২৮ এপ্রিল) রাজ্য পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল বিকাশ সহায় জানিয়েছেন, তাদের মধ্যে মাত্র ৪৫০ জনের বাংলাদেশি নাগরিকত্বের নথিপত্র দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
সংবাদসংস্থা পিটিআইকে বিকাশ সহায় বলেন, নথিভিত্তিক যাচাইয়ে এখন পর্যন্ত ৪৫০ জনকে বাংলাদেশি হিসেবে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। বাকি যাদের আটক করা হয়েছে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। আমরা মনে করি আরও অনেককে চিহ্নিত করা সম্ভব হবে।
শনিবার (২৬ এপ্রিল) ভোররাত থেকে শুরু হওয়া এই অভিযান প্রথমে আহমেদাবাদ ও সুরাত শহরে চালানো হয়, পরে তা ছড়িয়ে পড়ে গোটা গুজরাটে। ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ সন্দেহে যাদের আটক করা হয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকেরই ভারতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে।
সুরাতের বাসিন্দা সুলতান মল্লিক, যিনি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুরের বাসিন্দা এবং দীর্ঘ ছয় বছর ধরে সুরাতে এমব্রয়ডারির কাজ করেন, তাকেও বাংলাদেশি সন্দেহে আটক করে গুজরাট পুলিশ।
বিবিসি বাংলাকে তার স্ত্রী সাহিনা বিবি বলেন, রাত ৩টায় পুলিশ আসে। আধার কার্ড দেখতে চায়। তারপর আমার স্বামী ও দুই ভাগ্নেকে নিয়ে যায়। তারা বলে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবে, কিন্তু তিনদিন পেরিয়ে গেল—আর কোনো খোঁজ নেই।
বিবিসির কাছে মি. মল্লিকের ভারতীয় পাসপোর্ট ও ১৯৯৩ সালের জমির দলিলের কপি রয়েছে, যা তার ভারতীয় পরিচয় প্রমাণ করে। তবুও পুলিশ এখনো তাকে আদালতে হাজির করেনি, যা আইনের লঙ্ঘন।
বরযাত্রীও ছাড় পেল না পুলিশি অভিযানে
আহমেদাবাদে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে বরযাত্রী হিসেবে আসা মিজ. ফারজানার আত্মীয়দেরও পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে কেউই বাংলাদেশি নয়, এমনকি বাংলাভাষীও নন। মিজ. ফারজানা বলেন, আমার ভাই আর ভাতিজা মহারাষ্ট্র থেকে এসেছিল। বাংলাদেশি সন্দেহে পুলিশ তাদের আটক করে।
পুরোনো বাসিন্দারাও হেনস্থার শিকার
আহমেদাবাদের বাসিন্দা আলমআরা পাঠান জানান, তার ছেলে ও পুত্রবধূকে পুলিশ আটক করে যদিও তাদের সব ভারতীয় নথি ছিল। ২৩ বছর ধরে আমি আহমেদাবাদে থাকি। আমার ছেলে এখানেই জন্মেছে। তবুও তাকে বাংলাদেশি সন্দেহে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো, বলেন তিনি।
পরিযায়ী শ্রমিকদের আতঙ্ক ও দিশাহারা পরিবার
গুজরাটের ভারুচ জেলায় পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার পরিযায়ী শ্রমিক নূর শেখ জানান, তার এক বন্ধু পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে, যদিও তার সব ভারতীয় নথি রয়েছে।
পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠন ‘পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চ’ জানায়, শুধু গুজরাটেই নয়, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও ওড়িশা থেকেও পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের হেনস্থার একাধিক অভিযোগ উঠছে।
সংগঠনটির প্রধান আসিফ ফারুক বলেন, “এরকম প্রচুর অভিযোগ পাচ্ছি আমরা। সেই ২০১৪ সাল থেকেই এগুলো চলছে আর দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। পেহেলগাঁওকাণ্ডের পরে তো আরও বেড়েছে এটা। কোথাও স্থানীয় পুলিশ, কোথাও বা ছোটখাটো হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের লোকজন পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী মুসলমান পরিযায়ী শ্রমিকদের হেনস্থা করছে, মারধর করছে। সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশি তকমা লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
“ভারতের নাগরিক হিসেবে কী দেশের যেকোনও জায়গায় গিয়ে কাজ করার বা ব্যবসা করার অধিকার নেই বাংলাভাষী আর মুসলমান বলে?” প্রশ্ন আসিফ ফারুকের।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনার আড়ালে একটি বৃহত্তর সম্প্রদায়ভিত্তিক নজরদারি চলছে। পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চের প্রধান আসিফ ফারুক প্রশ্ন রাখেন, বাংলাভাষী ও মুসলমান হলেই কি নাগরিক অধিকার খর্ব হবে? এরা কি ভারতের অন্য কোথাও কাজ করতে পারবে না?
সূত্র : বিবিসি বাংলা
