দুপুরের সূর্য তখনো কড়া হয়ে ওঠেনি। ঢাকার উত্তরার দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন কলেজ- যেখানে শিশুরা প্রতিদিন স্বপ্ন নিয়ে আসে, শিক্ষা নিয়ে যায়- সেই আকাশে আচমকা থমকে যায় পৃথিবী। বাংলাদেশ এয়ারফোর্স‑এর একটি প্রশিক্ষণ বিমান অপ্রত্যাশিতভাবে বিধ্বস্ত হয়ে সোজা কলেজ ভবনের প্রাইমারি সেকশনে গিয়ে আছড়ে পড়ে। মুহূর্তেই আগুন, ধোঁয়া আর কান্নার আওয়াজে ভারী হয়ে ওঠে বাতাস। আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় একাধিক কোমলমতি শিশু। হাসপাতালের বিছানায় যাদের বাঁচা মরার লড়াই, তারা এখনো বোঝেনি কেন ভেঙে পড়েছিল সেই আকাশ।
এ যেন এক বাংলাদেশি গ্রিনফেল! সেই লন্ডনের মতোই যেখানে একটি আবাসিক টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে গিয়েছিল ৭২টি প্রাণ। দুই দেশের দুটি ট্র্যাজেডির মাঝে ব্যবধান কেবল একটাই—একটিতে রাষ্ট্র দায় নিয়েছিল, অন্যটিতে রাষ্ট্রপ্রধানরা সেলফি তুলতে এসেছিলেন। গ্রিনফেল টাওয়ারে আগুন লাগে ২০১৭ সালের ১৪ জুন, পশ্চিম লন্ডনের নর্থ কেনসিংটনে। রাত ১টা ৩০ মিনিটে রান্নাঘরের ফ্রিজ থেকে আগুনের সূচনা হলেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ভবনের অগ্নিনির্বাপক দুর্বল কাঠামোর কারণে।
লন্ডনের দমকল বাহিনী মাত্র ছয় মিনিটের মাথায় ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। ২৪০ জন দমকলকর্মী, ৭০টি ফায়ার ইঞ্জিন, হেলিকপ্টার, বিশেষ প্রশিক্ষিত উদ্ধারকারী দল একযোগে অভিযান চালায়। কনসারভেটিভ পার্টির প্রভাবশালী কাউন্সিলের অবহেলা, অগ্নিনির্বাপক নীতির দুর্বলতা ও সস্তা ক্ল্যাডিং ব্যবহার করে বিল্ডিংকে 'সুন্দর' করার চেষ্টাই পরিণত হয় গণহত্যায়। ব্রিটেনের প্রিন্স উইলিয়াম ও রানী এলিজাবেথ স্বজনহারাদের পাশে দাঁড়ান, হাউজ অফ কমন্সে চলে বিতর্ক, ইনকোয়ারি রিপোর্টে দোষীদের চিহ্নিত করে মামলা হয়।
আর বাংলাদেশ? দিয়াবাড়ির ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে স্থানীয় জনগণ প্রথমে এগিয়ে আসে, ঠিক যেমন সবসময় হয়—হাসপাতাল, আগুন নেভানো, বাচ্চাদের গায়ে পানি ঢেলে দেওয়া, ছোটাছুটি। কিন্তু তার কয়েক ঘণ্টা না যেতেই চেনা সেই তামাশার মঞ্চ শুরু হয়। রাজনীতিবিদরা ‘শোক জানাতে’ এসে হাসপাতালের করিডর দখল করেন, সাংবাদিকরা ক্যামেরা তাক করেন সেই শিশুদের মুখে, যাদের শরীর তখনো দগ্ধ। tiktok স্টার ও কনটেন্ট ক্রিয়েটররা যেন আগুনের গন্ধে মশার মতো জড়ো হন। লাইভ চলে- “দেখুন, আমি ঘটনাস্থলে।” কেউ আবার ব্যাকগ্রাউন্ডে কান্না ধরেন, কেউ দাঁড়ান মৃত বাচ্চার পোস্টারের পাশে, যেন সেটিই তাদের সবচেয়ে বড় কনটেন্ট!
আমরা যারা প্রবাসে থাকি, হাজার মাইল দূরে- লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, সিডনি বা টরন্টোয়-আমরাও এই লাইভ দেখি, চোখে জল আসে, বুক ফেটে কান্না বেরোয়। এইতো কয়েক দিন আগেই নিজের সন্তানের জন্মদিনে মাইলস্টোন স্কুলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছিলাম, আজ সেখানেই পড়ে আছে এক জোড়া পুড়ে যাওয়া জুতো। প্রবাসের মানুষ শুধু রেমিট্যান্স পাঠায় না, তারা একদা ওই মাটিতে হেঁটেছিল, ওই স্কুলে পড়েছিল, সেখানেই তাদের শৈশব, স্বপ্ন আর মা- বাবার গন্ধ। অথচ এই রাষ্ট্র আমাদের কান্নাও শোনে না, আমাদের ক্ষোভও বোঝে না।
আমরা প্রশ্ন করি : কেন একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান জনবহুল এলাকায় ওড়ানো হবে? কেন ফ্লাইট ট্রেইনিং ইনস্টিটিউট ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অনুমোদন পায়? দুর্ঘটনার পরে দমকল বাহিনী, অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশ কত সময়ে পৌঁছেছিল? কেন হাসপাতালে ঢোকার পথ রাজনৈতিক মিছিল, মিডিয়ার ভিড় আর কনটেন্ট-সৃষ্টিকারীদের বিক্ষোভে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল? এই প্রশ্নগুলো জিজ্ঞাসা করা প্রতিহিংসা নয়, বরং গভীর ব্যথা থেকে উৎসারিত এক মানবিক অনুরোধ। আমরা যারা বিদেশে আছি, অজস্র মাইল দূরে বসেও, হৃদয়ের প্রতিটি ধ্বনি শুনতে পাই মাতৃভূমির রক্তক্ষরণ। একেকটি দুর্ঘটনার সংবাদ আমাদের ঘুম কাড়ে, নিঃশ্বাস ভারী করে। দেশে থাকা প্রিয়জনের চিন্তা, অসহায় মানুষের আর্তনাদ, আর এই নিষ্ক্রিয়তার যন্ত্রণায় আমরাও প্রতিদিন ভেঙে পড়ি।
এগুলো কোনো প্রতিহিংসাপূর্ণ প্রশ্ন নয়, এগুলো উত্তর খোঁজার আকুতি। যারা সন্তান হারিয়েছে, যারা আগুনে ঝলসে যাওয়া মুখ নিয়ে বাঁচবে, যারা এখনো জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে পারছে না, তাদের পাশে দাঁড়ানোই তো মানবিকতা। আমরা যারা প্রবাসে থাকি, সব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ছাড়িয়ে, দিন শেষে দেশের প্রতিটি কান্না আমাদের বুক ফাটিয়ে দেয়। আমাদের সন্তানদের চোখে অশ্রু আসে যখন তারা দেখে নিজ জন্মভূমি যেন অচেনা, অস্থির, অব্যবস্থাপনার যন্ত্রণায় জর্জরিত। আমরা চাই না শুধু বিদেশে বৈধতা পাওয়ার জন্য পরিচয়পত্রে ‘বাংলাদেশ’ লেখা থাকুক; আমরা চাই অন্তরে এক গর্বিত ও নিরাপদ বাংলাদেশ গাঁথা থাকুক।
বাংলাদেশে যেন প্রতিটি দুর্ঘটনা হয়ে ওঠে একেকটি শোকের মিছিল। ভবন ধসে পড়ে, আগুন লাগে, লঞ্চ ডুবে যায়—কিন্তু প্রতিবার আমরা দেখি, প্রাথমিক সাড়া পড়ে জনগণের মাধ্যমে, রাষ্ট্রযন্ত্র পরে আসে। মিডিয়া আর রাজনীতি এই শোককে পরিণত করে একেকটি প্রদর্শনীর মঞ্চে। অথচ এই মুহূর্তে প্রয়োজন ছিল নিঃশব্দ ভালোবাসার, সাহায্যের হাত, চিকিৎসার গতি এবং তদন্তের স্বচ্ছতা। প্রবাসে থেকে আমরা দেখেছি—কোনো ট্র্যাজেডি কীভাবে রাষ্ট্র, প্রশাসন ও নাগরিক সমাজ একসঙ্গে কাঁধে তুলে নেয়। সেখানে কাঁদতে দেয়, উদ্ধার করে, চিকিৎসা দেয়, সত্য বের করে। অথচ আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে এই প্রতিক্রিয়ার পরিবর্তে দেখি চিৎকার, বিশৃঙ্খলা ও আত্মপ্রচারের উৎসব। আমরা চাই, দেশ হোক দায়িত্ববান, হৃদয়বান, মানুষের পাশে দাঁড়াতে জানা এক বিশ্বস্ত রাষ্ট্র।
আমরা চাই এই দুর্ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হোক, বিচার হোক বিমান বাহিনী কর্তৃপক্ষ, অনুমোদনদাতা সংস্থার। রাজনীতিকে শোক থেকে দূরে রাখা হোক। মিডিয়া ও কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের জন্য হাসপাতাল ও দুর্ঘটনাস্থলে নিয়মকানুন নিশ্চিত করা হোক। দগ্ধ শিশুদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা নিশ্চিত করা হোক, চিরস্থায়ী তহবিল গঠন করা হোক। আমরা চাই, কোনো মা যেন সন্তানকে আগুনে ঝলসে যেতে না দেখে, কোনো বাবা যেন হাসপাতালের গেটে দাঁড়িয়ে আর্তচিৎকার না করে। প্রবাসে থেকেও আমরা এই সব রকম সহযোগিতায় অংশ নিতে প্রস্তুত—শুধু রাষ্ট্র আমাদের কণ্ঠ শুনুক, আমাদের বিশ্বাস ফিরিয়ে দিক। দুর্ঘটনা প্রতিরোধের দায় শুধু সরকারের নয়, তা আমাদের সবার; কিন্তু দায়িত্ব পালনের নেতৃত্ব তো রাষ্ট্রকেই নিতে হবে, অন্তত আজ, অন্তত এখন।
আর চাই—এই রাষ্ট্র একদিন বুঝুক, কান্নারও অধিকার আছে। সেই কান্না নিয়ে কেউ লাইভ করতে পারে না, কেউ সেলফি তুলতে পারে না। মৃত্যুর চেয়ে বড় কিছু নেই। আর তার চেয়েও বড় একটিই বিষয়—একটি রাষ্ট্রের বিবেক। বিদেশে থেকেও আমরা বারবার বলি—আমাদের দেশ হোক করুণার নয়, ন্যায়ের প্রতীক। শোক হোক নীরব শক্তি, দুঃখ হোক দায়িত্বের দ্যুতি। আজ আমরা দেখছি, আমাদের মানুষ মরছে—আর তাদের মৃত্যু নিয়ে তৈরি হচ্ছে কনটেন্ট, পলিটিক্স আর পাবলিসিটি। এই লজ্জা প্রবাসে নিয়ে হাঁটতে কষ্ট হয়। আমরা তো চেয়েছিলাম গৌরবের বাংলাদেশ, কিন্তু পাচ্ছি এক মঞ্চায়িত শোকের নাটক।
এই দুর্ঘটনা আমাদের জন্য আরেকটি গ্রিনফেল হোক; শিক্ষণীয়- শুধুমাত্র ‘আলহামদুলিল্লাহ’ প্রহসনের নয়, জবাবদিহির। দেশের সরকার, প্রশাসন, মিডিয়া এবং নাগরিক সমাজ সবাই মিলে যেন প্রতিজ্ঞা করে, আর একটি শিশুও যেন এমনভাবে না মারা যায়। আর একটি কান্নাও যেন অকারণে বাতাসে ভেসে না যায়। আর আমরা যারা বিদেশে থাকি, তাদের চোখের জলের দাম যেন কেউ দেয় না দিক, অবহেলা অন্তত না করে। কারণ বাংলাদেশ শুধু মাটির ভেতর নয়, হৃদয়ের গভীরেও বাস করে। আমরা হোটেলের বালিশে মাথা রাখলেও ঘুম আসে না, কারণ কান্নার শব্দ কানে বাজে। প্রবাসে আমাদের সফলতা, নিরাপত্তা, পাসপোর্ট—সব কিছুর ওপরে যে জিনিসটি থাকে, সেটি হলো একখণ্ড দেশের নাম—‘বাংলাদেশ’। এই নামের মান যেন আর কখন রক্তে ভেসে না যায়।
আমরা প্রশ্ন করি কারণ আমাদের রক্তে দেশের ঘ্রাণ, আমাদের চোখে শিকড় জলে ভেজা ঘুম। আমরা প্রশ্ন করি কারণ আমরা ভালোবাসি। প্রবাসে থাকি বটে, কিন্তু হৃদয়ের প্রতিটি কণায় দেশকে নিয়ে যাই। তাই আমাদের এই অনুরোধ রাষ্ট্রের কাছে নয়—মানবতার কাছে। যেন আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ একদিন কান্নাহীন, শোকার্ত নয়, সুবিচার আর সহানুভূতির এক পূর্ণ রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়ায়—অন্ধকারের নয়, আলোর প্রতিশ্রুতি হয়ে।
লেখক: কবি-কলামিস্ট
