জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে ৪১ ঘণ্টারও বেশি, কিন্তু এখনো পর্যন্ত শেষ হয়নি ভোট গণনা। আনুষ্ঠানিকভাবে ফলাফল ঘোষণা করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। ফল ঘোষণায় বিলম্বের কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন শিক্ষার্থীরা। অনিয়ম ও প্রশাসনিক অদক্ষতা মিলিয়ে নির্বাচনি পরিবেশ ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে, ম্যানুয়াল (হাতে) ভোট গণনার জটিলতাই দেরির মূল কারণ। শুরুতে ওএমআর মেশিনে গণনার পরিকল্পনা থাকলেও, কয়েকজন প্রার্থীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ম্যানুয়াল গণনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এতে সময় অনেক বেশি লাগছে। এছাড়া কেন্দ্র থেকে ব্যালট বাক্স আসতেই দেরি করায় গণনাও শুরু হয় দেরিতে। তার ওপর ভোট গণনাকালে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্বপালনকারী শিক্ষিকা জান্নাতুল ফেরদৌস আকস্মিক অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন। মাঝখানে ভোট গণনা বন্ধ করে ওএমআর মেশিনে গণনার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। পরে নির্বাচন কমিশন এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জরুরি বৈঠকে ফের ম্যানুয়ালি ভোট গণনার সিদ্ধান্ত হয়। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও নির্বাচন কমিশনের সদস্য সচিব একেএম রাশিদুল আলম আশাবাদ ব্যক্ত করেন- শুক্রবারের মধ্যেই গণনা সম্পন্ন করে বেসরকারিভাবে ফল প্রকাশ করতে পারবো।
এদিকে সকাল ৯টায় ভোটগ্রহণ শুরু হলেও কয়েকটি হলে দেরি হয়। দুইটি বড় হলে দুপুর পর্যন্ত ভোটার উপস্থিতি কম থাকায় ভোটগ্রহণ বিলম্বিত হয়। বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে লাইনে ভোটারদের ভিড় বাড়ে, ফলে ভোট শেষ হয় প্রায় রাত ৯টার দিকে। ব্যালট বাক্স সব কেন্দ্র থেকে না আসায় রাত ১০টার আগে গণনা শুরু করা যায়নি। অন্যদিকে সিনেট ভবনের কক্ষে শুরুর দিকে ৫টি টেবিলে গণনা চললেও পরে তা বাড়িয়ে ১০টি করা হয়। সিসিটিভির মাধ্যমে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করা হয়। কিন্তু বহু কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট উপস্থিত না থাকায় গণনায় বিলম্ব হয়।
ভোট গণনার সময় শিক্ষকের মৃত্যু
সবচেয়ে বড় ধাক্কা আসে যখন ভোট গণনার সময় চারুকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জান্নাতুল ফেরদৌস আকস্মিকভাবে অসুস্থ হয়ে মারা যান। এই ঘটনায় ভোট গণনা বন্ধ রাখা হয় এবং সার্বিক পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়ে। তার মৃত্যুতে ভেঙে পড়েন সহকর্মীরা।
নওয়াব ফয়জুন্নেসা হলের রিটার্নিং কর্মকর্তা সুলতানা আকতার বলেন, যদি মেশিনে গণনা হতো, হয়তো জান্নাতুল ফেরদৌস এখনো আমাদের মাঝে থাকতেন। তিনি ঘোষণা দেন, 'এখন থেকে ওএমআর পদ্ধতি ছাড়া গণনায় আমি থাকবো না।'
শুক্রবার (১২ সেপ্টেম্বর) সকাল আটটার দিকে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন সহকারী অধ্যাপক জান্নাতুল ফেরদৌস। তখন তিনি জাকসু নির্বাচন কমিশনে উপস্থিত হওয়ার পর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। দ্রুত তাকে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
অভিযোগের পাহাড়
নির্বাচনে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তুলে ছাত্রদলসহ ৫টি প্যানেল ভোট বর্জন করে। বর্জনকারীদের মধ্যে রয়েছে প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের সম্প্রীতির ঐক্য, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র ফ্রন্টের 'সংশপ্তক পর্ষদ', এবং স্বতন্ত্রদের ‘অঙ্গীকার পরিষদ’। এছাড়া ছাত্র ফ্রন্টের একটি বিভাজিত অংশ এবং কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীও ভোটগ্রহণ বর্জনের ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তুলে পদত্যাগ করেন জাকসু নির্বাচন কমিশনের সদস্য ও জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সভাপতি মাফরুহী সাত্তার।
তাদের অভিযোগের মধ্যে রয়েছে- অতিরিক্ত ব্যালট ছাপানো, জাল ভোট, ভোটার তালিকায় ছবি না থাকা, একাধিকবার ভোটদানের সুযোগ, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে ভোট কারচুপির চেষ্টা, প্রার্থীদের কেন্দ্র পরিদর্শনে বাধা,অমোছনীয় কালি ব্যবহার না করা।
শিবিরের সমর্থিত প্যানেল ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করে, ওএমআর বাতিল করে ম্যানুয়াল পদ্ধতি চাপিয়ে দিয়ে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, ফল দ্রুত প্রকাশ না হলে কঠোর অবস্থানে যাওয়া হবে।
সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের জিএস প্রার্থী বলেন, 'আমাদের কিছু গুরুতর অভিযোগ আছে। প্রথমত, প্রশাসনের মধ্যে একটি পক্ষ আছে যারা ঠুনকো অজুহাতে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে স্থগিত করতে চায়। ছাত্রদলের ঠুনকো অজুহাতে তারা যেমন ওএমআর বাতিল করেছে, একইভাবে তারা নির্বাচনকেও বানচাল করতে চাচ্ছে।'
শিক্ষার্থীদের দাবি
শুক্রবার (১২ সেপ্টেম্বর) বিকালে শিক্ষার্থীরা নির্বাচন কমিশনারের কার্যালয়ের সামনে জড়ো হন। তারা স্লোগান দিয়ে দাবি জানান, রাত ১০টার মধ্যে জাকসু ও হল সংসদের ফলাফল ঘোষণা করতে হবে।
বাগছাস প্যানেলের মনোনীত জিএস প্রার্থী, আবু তৌহিদ মো. সিয়াম বলেন, মাঝপথে এসে কোনো মেশিন নয় বরং একই পদ্ধতিতে লোকবল বাড়িয়ে গণনা চালাতে হবে এবং দ্রুততার সঙ্গে জাকসু ও হল সংসদের ফলাফল ঘোষণা করতে হবে।
তিনি বলেন, একই নির্বাচনে দুইটা ভিন্ন পদ্ধতিতে ভোট গণনা করে নির্বাচনকে আরও ত্রুটিযুক্ত করবেন না এবং ভোট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে জড়িত সকলের সব ধরনের ষড়যন্ত্র রুখে দিন।
শিক্ষার্থীরা বলছেন- ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ভোট গণনার জন্য ফলাফলে এত বিড়ম্বনা। তারা দাবি জানিয়েছিলেন- ওএমআর পদ্ধতিতে অতি দ্রুত স্বচ্ছভাবে ভোট গণনা করে ফল প্রকাশের। কিন্তু নির্বাচন কমিশন ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ করায় একদিন পার হলেও ফলাফল দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
হঠাৎ ভোট গণনা বন্ধ
শুক্রবার (১২ সেপ্টেম্বর) বিকালে হঠাৎ ভোট গণনা বন্ধ রাখা হয়। পাঁচটা থেকে সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত বন্ধ ছিল গণনা। ভোট গণনা বন্ধ রেখে নির্বাচন কমিশন এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মধ্যে একটি জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের লক্ষ্যে উভয় পক্ষই আলোচনায় যুক্ত হয় বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। পরে সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে পুনরায় ভোট গণনা শুরু হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেন জাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনিরুজ্জামান।
এসময় জাকসু নির্বাচন কমিশনের সদস্য ড. লুৎফুল এলাহী বলেন, 'আমরা পুরোদমে কাজ করে যাচ্ছি, আর মাত্র তিনটি হল সংসদের ভোট গণনা বাকি। আমরা গণনার জন্য টেবিল সংখ্যা বৃদ্ধি করেছি।'
এদিকে জাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৬৭ দশমিক ৯ শতাংশ। নির্বাচনে মোট ভোটার ছিলেন ১১ হাজার ৯১৯ জন। এর মধ্যে ছাত্র ৬ হাজার ১১৫ জন এবং ছাত্রী ৫ হাজার ৭২৮ জন। ভোট পড়েছে মোট ৮ হাজার ১৬। বিভিন্ন পদে মোট ১৭৮ জন প্রার্থী চূড়ান্তভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এরমধ্যে সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে ৯ জন, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ৯ জন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (নারী) পদে ৬ জন এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ১০ জন। কেন্দ্রীয় ও হল সংসদে প্রায় ৫৪৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন ১০২ জন।
ছাত্রীদের হলভিত্তিক ভোটার সংখ্যা-
নওয়াব ফয়জুন্নেসা হলে ২৭৯ জন, জাহানারা ইমাম হলে ৩৬৭ জন, প্রীতিলতা হলে ৩৯৬ জন, বেগম খালেদা জিয়া হলে ৪০৩ জন, সুফিয়া কামাল হলে ৪৫৬ জন, ১৩ নম্বর ছাত্রী হলে ৫১৯ জন, ১৫ নম্বর ছাত্রী হলে ৫৭১ জন, রোকেয়া হলে ৯৫৬ জন, ফজিলাতুন্নেছা হলে ৭৯৮ জন এবং তারামন বিবি হলে ৯৮৩ জন।
ছাত্রদের হলভিত্তিক ভোটার সংখ্যা-
আল বেরুনী হলে ২১০ জন, আ ফ ম কামালউদ্দিন হলে ৩৩৩ জন, মীর মশাররফ হোসেন হলে ৪৬৪ জন, শহীদ সালাম-বরকত হলে ২৯৮ জন, মওলানা ভাসানী হলে ৫১৪ জন, শহীদ রফিক-জব্বার হলে ৬৫০ জন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে ৩৫০ জন, ২১ নম্বর ছাত্র হলে ৭৩৫ জন, জাতীয় কবি নজরুল হলে ৯৯২ জন এবং তাজউদ্দীন আহমদ হলে ৯৪৭ জন।
এদিকে বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তুলে ফের নির্বাচনের দাবি জানায় চারটি প্যানেলের প্রার্থীরা। প্যানেলগুলো হলো সম্প্রীতির ঐক্য, সংশপ্তক পর্ষদ, অঙ্গীকার পরিষদ, ছাত্র ফ্রন্ট একাংশের প্যানেল।
এবারের নির্বাচনে ২৫টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ১৭৮ প্রার্থী। নির্বাচনে বামপন্থী, শিবির, ছাত্রদল ও স্বতন্ত্র শিক্ষার্থীদের সমর্থিত ৮টি প্যানেল অংশগ্রহণ করে। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত, ২১টি হল সংসদ নির্বাচনের মধ্যে ১৫টি হলের ভোট গণনা শেষ হয়েছে এবং ৮টি হলের ফল ঘোষণা করা হয়েছে।
অনানুষ্ঠানিক ফলে ভিপি জিএস পদে এগিয়ে আছেন যারা
জাকসু নির্বাচনে ১৩ কেন্দ্রের ভোট গণনা শেষ
জাকসুর ফল ঘোষণার আগেই নির্বাচন কমিশনারের পদত্যাগ
জাকসু: পুনরায় ভোট গণনা শুরু
চলছে ভোট গণনা, বাকি ৩ হল
দায়িত্ব পালনকালে পোলিং অফিসারের মৃত্যু