ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

বদনজর থেকে বাঁচতে যা করবেন

আপডেট : ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ০২:৪৩ এএম

সমাজে এমন অনেক বিষয় প্রচলিত আছে, যেগুলো নিয়ে নানা ভ্রান্ত ধারণা ও বিশ্বাস বিদ্যমান। এর মধ্যে অন্যতম হলো ‘বদনজর’। কখনও হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়া। কখনও ভালো ব্যবসা হঠাৎ মন্দা হওয়া। আবার কখনও সুখী পরিবারে অপ্রত্যাশিত অশান্তি দেখা, এই সবের পেছনে অনেকেই বলে, ‘নজর লেগেছে।’ 

আধুনিক যুক্তিবাদী মন হয়তো এটিকে হাস্যকর মনে করতে চাইবে, কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে বদনজর কোনো কুসংস্কার নয়। বরং এটি একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য ও বাস্তবতা।

বদনজর বা ‘আল-আইন’ হলো এমন এক অদৃশ্য প্রভাব, যা কোনো হিংসুক বা অতিমাত্রায় আগ্রহী ব্যক্তির দৃষ্টি থেকে অন্যের প্রতি প্রেরিত হয় এবং তার জীবনে ক্ষতি করতে পারে। আজকের সময়ে, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তের সুখ, সাফল্য ও সৌন্দর্য যেন সকলের সামনে প্রদর্শনের বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বদনজরের প্রভাব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। 

বদনজর কীভাবে হয়

বদনজর বা নজর মূলত দুই ধরনের হয়।

প্রথমটি হিংসা থেকে উদ্ভূত

অর্থাৎ যখন কেউ অন্যের কোনো নিয়ামত দেখে ঈর্ষা অনুভব করে এবং মনে মনে সেটি হারিয়ে যাওয়ার কামনা করে, তখন তার দৃষ্টিতে ক্ষতি থাকতে পারে। এই ধরনের নজরই প্রকৃত হিংসাপূর্ণ বদনজর।

দ্বিতীয়টি অতি-প্রশংসা বা বিস্ময় থেকে উদ্ভূত

কখনও কখনও কেউ অন্যের কোনো গুণ বা নিয়ামত দেখে অতিমাত্রায় মুগ্ধ হয় বা বিস্মিত হয়। যদি সে আল্লাহর প্রশংসা যেমন ‘মাশাআল্লাহ’ বা ‘বারাকাল্লাহু ফিক’ না করে, তখন এমন দৃষ্টি থেকেও বদনজর জন্ম নিতে পারে। এমনকি একজন ভালো মানুষও অনিচ্ছাকৃতভাবে এমন নজর দিতে পারেন।

কুরআনের আলোকে বদনজরের বাস্তবতা

ইসলামি আকিদার একটি মূলনীতি হলো ‘গাইবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন’। বদনজরও সেই অদৃশ্য বিষয়গুলোর একটি, যার অস্তিত্ব কুরআন ও হাদিসে স্বীকৃত।

১. সুরা আল-ফালাক (১-৫) –আল্লাহ আমাদের শিখিয়েছেন হিংসুকের ক্ষতিকর দৃষ্টির হাত থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতে। বদনজর হলো হিংসুকের অনিষ্টের এক প্রকাশ।

২. সুরা আল-কালাম (৫১) – কাফিররা যখন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি হিংসাপূর্ণ দৃষ্টি প্রেরণ করতো, আল্লাহ তা উল্লেখ করেছেন। এটি বদনজরের প্রকৃতির স্পষ্ট নিদর্শন।

৩. সুরা ইউসুফ (৬৭) – ইয়াকুব (আ.) তার সুদর্শন পুত্রদের একসঙ্গে একই দরজা দিয়ে না পাঠিয়ে সতর্ক করেছিলেন। কারণ একসাথে উপস্থিত হলে মানুষের হিংসাপূর্ণ বা অতিমাত্রা মুগ্ধ দৃষ্টির (বদনজর) সম্ভাবনা থাকে। এটি বদনজর থেকে রক্ষা পাওয়ার একটি শিক্ষণীয় ব্যবস্থা।

হাদিসের আলোকে বদনজরের বাস্তবতা

১. বদনজর সত্য ও বাস্তব – আবু হুরাইরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবি (সা.) বলেছেন: ‘বদনজর সত্য।’ উল্কি অংকনও এ থেকে বাঁচার জন্য নিষিদ্ধ। (সহিহ বুখারি ৫৭৪০, ইবনে মাযাহ ৩৫০৮)

২. তাকদির অতিক্রম করার ক্ষমতা: বদনজরের প্রভাব এত শক্তিশালী যে, এটি ভাগ্যকে অতিক্রম করতে পারে। (তিরমিজি- ২০৫৯)

৩. প্রভাবের উদাহরণ ও প্রতিকার: আবু উমামা (রা.) বর্ণনা করেছেন, এক সুসুন্দর ব্যক্তির দৃষ্টিতে সাহল (রা.) অসুস্থ হয়ে যান। নবী (সা.) পানি ও দোয়ার মাধ্যমে প্রতিকার নির্দেশ করেন। (ইবনে মাজাহ ৩৫০৯)

•শিক্ষা: বদনজর শুধু হিংসুকের নয়, কোনো মুগ্ধ দৃষ্টিও প্রভাব ফেলতে পারে।

৪. ভয়াবহতা: নবি (সা.) সতর্ক করেছেন যে, উম্মতের মধ্যে মৃত্যুর ক্ষেত্রে বদনজরের কারণে মৃত্যুর ঘটনা তাকদিরের পর সর্বাধিক। (মুসনাদে বাযযার)

এই হাদিসগুলো থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, বদনজর কেবল মানসিক বা কাল্পনিক বিষয় নয়, এটি একটি শারীরিক ও বাস্তবসম্মত ক্ষতি, যা আল্লাহর হুকুমে মানুষের জীবন, স্বাস্থ্য, সম্পদ ও সম্পর্কের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।

বদনজরের প্রতিরোধ ও প্রতিকার

বদনজরের এই ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে হলে আত্মশুদ্ধি এবং ইসলামি নির্দেশিত প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য।

প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা

আত্মশুদ্ধি: বদনজর প্রতিরোধের প্রথম ধাপ হলো নিজের অন্তরকে হিংসা ও ঈর্ষা থেকে মুক্ত করা। অন্যের সাফল্য, সৌন্দর্য বা নিয়ামত দেখে অন্তর থেকে তার জন্য বরকতের দোয়া করা উচিত, ‘আল্লাহ তাকে আরও বরকত দিন।’ এ বিশ্বাস দৃঢ় রাখতে হবে যে, সবকিছুর প্রকৃত রক্ষাকারী একমাত্র আল্লাহ তাআলা। তিনিই উপকার বা ক্ষতি করার মালিক।

নিয়মিত যিকির ও দোয়া

সকাল-সন্ধ্যার দোয়া: রাসুল (সা.) এর নির্দেশিত সকাল ও সন্ধ্যার দোয়াগুলো প্রতিদিন পাঠ করা বদনজরের বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা। এই দোয়াগুলো একসাথে বই আকারে পাওয়া যায়। 

সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক, নাস, আয়াতুল কুরসি তেলাওয়াত করা। যখন নিজের বা অন্যের কোনো সুন্দর জিনিস, সাফল্য বা নিয়ামত দৃষ্টিগোচর হবে তখন ‘মাশাল্লাহ ও বারাকাল্লাহ’ পড়া। 

নিয়ামত গোপন রাখা: নিজের সুখ, সাফল্য, সম্পদ বা জীবনের বিশেষ আনন্দঘন মুহূর্তগুলো অহেতুক প্রকাশ না করা।  বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সবাই আপনার জন্য শুভাকাঙ্ক্ষী নয়; অনেকে অজান্তেই হিংসা বা নজরের কারণ হতে পারে। তাই নিয়ামত গোপন রাখলে আল্লাহ তাআলা আরও বরকত দেন।

প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা

প্রথমত: বদনজরের চিকিৎসা বা প্রতিকার হলো রুকইয়াহ শারইয়্যাহ, অর্থাৎ শরীয়তসম্মত ঝাড়ফুঁক। এর পদ্ধতি হলো সুরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসি, সুরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পাঠ করে আক্রান্ত স্থানে ফুঁ দেওয়া বা আক্রান্ত ব্যক্তির উপর নির্ধারিত দুআগুলো পড়া। 

দ্বিতীয়ত: ওজু বা গোসলের পানি দিয়েও প্রতিকার করা যায়। সাহল ইবনু হনাইফ (রা.)-এর ঘটনায় প্রমাণিত যে, যার কারণে বদনজর লেগেছিল, তার ওজুর পানি আক্রান্ত ব্যক্তির উপর ঢেলে দেওয়া হয়েছিল, এবং আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি আরোগ্য লাভ করেন।

তৃতীয়ত: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তাওয়াক্কুল, অর্থাৎ দৃঢ় বিশ্বাস রাখা যে, একমাত্র আল্লাহই আরোগ্য দানকারী ও রক্ষাকারী। কোনো প্রতিকার বা চিকিৎসা নিজে থেকে কার্যকর হয় না—বরং আল্লাহর অনুমতিতে তাতে প্রভাব সৃষ্টি হয়। তাই মুমিন কখনো কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না, বরং আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রাখে।

বদনজর কোনো কল্পনা নয়, এটি বাস্তব এবং প্রমাণিত বিষয়। বর্তমান যুগে বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রদর্শনের সংস্কৃতি, নিজের সাফল্য, সন্তান, সম্পদ, বা সুখী জীবনের অতিরিক্ত প্রদর্শন। এই অদৃশ্য বিপদকে আরও বৃদ্ধি করছে। অনেকে না বুঝেই নিজের সুখ-সৌন্দর্য অন্যের নজরে এনে বিপদ ডেকে আনে। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজক করুন। 

HN
আরও পড়ুন