ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

ইসলামের দৃষ্টিতে সাংবাদিকতা, সত্যের লড়াই

আপডেট : ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:১৬ এএম

আধুনিক সাংবাদিকতার মূলনীতি ও দায়িত্বশীলতা নিয়ে যখন আলোচনা চলে, তখন ইসলামের শাশ্বত শিক্ষামালা সেই চর্চায় এক গভীর নৈতিক ভিত্তি যোগ করে। পবিত্র কুরআন ও মহানবী (সা.)-এর হাদিসসমূহে একজন সাংবাদিক বা তথ্য প্রচারকারীর জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নির্ধারণ করা হয়েছে, যেখানে সত্যের প্রতিষ্ঠা, তথ্য যাচাই এবং নৈতিকতার অনুসরণ হলো সর্বাগ্রে।

১. মূল লক্ষ্য: সত্যের পথ অবলম্বন ও অনাচার উদ্‌ঘাটন

ইসলামে সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য কেবল খবর পরিবেশন নয়, বরং এটি একটি ইমানি দায়িত্ব। এর প্রাথমিক লক্ষ্য হলো ধর্মের প্রচার, সত্যের পথে অবিচল থাকা এবং সমাজে বিদ্যমান অনাচার ও অন্যায় উদ্‌ঘাটন করে তার অবসান ঘটানো।
কুরআন মাজিদে মহান আল্লাহ স্পষ্ট ভাষায় সতর্ক করেছেন: "তোমরা সত্যকে আড়াল কোরো না মিথ্যার পোশাকে এবং জেনেশুনে সত্যকে চেপে যেও না।" (সুরা বাকারা, আয়াত: ৪২)

২. তথ্যের অতিরঞ্জন নিষিদ্ধ ও সততার নির্দেশ

ইমানি চেতনার পরিপন্থী যেকোনো কাজ থেকে বিরত থাকার কঠোর নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। বিশেষ করে তথ্যের অতিরঞ্জন, অস্পষ্টতা বা অসম্পূর্ণতা একজন বিশ্বাসীর জন্য পরিত্যাজ্য।

আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে সবসময় সত্য কথা বলার নির্দেশ দিয়েছেন: "হে ইমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্য কথা বলো, তাহলেই তিনি তোমাদের কর্মের পরিশুদ্ধি দান করবেন।" (সুরা আহজাব, আয়াত: ৭০)
 
৩. সাংবাদিকতার অন্যতম শর্ত: সঠিক তথ্য যাচাই

ইসলামী সাংবাদিকতার অন্যতম মৌলিক ও অপরিহার্য শর্ত হলো তথ্যের সঠিকতা নিশ্চিত করা। কোনো খবর প্রচারের আগে তার সত্যতা যাচাই করা বাধ্যতামূলক। তথ্যের উৎস যদি "পাপাচারী" (ফাসেক) হয়, তবে তার যাচাই-বাছাইয়ের ওপর আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

মহান আল্লাহ বলেন: "হে বিশ্বাসীগণ, যদি কোনো পাপাচারী তোমাদের জন্য কোনো খবর নিয়ে আসে, তাহলে অবশ্যই তা তোমরা পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখবে। যেন ভুল, অজ্ঞতার কারণে তোমরা নিজেদের ক্ষতিসাধনে জড়িয়ে না যাও এবং পরে যেন তোমরা তোমাদের পূর্বকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হও।" (সুরা হুজুরাত, আয়াত: ০৬)

৪. তথ্য গোপন করা মহাপাপ: স্বার্থের ঊর্ধ্বে সত্য

ব্যক্তিগত স্বার্থ, দলগত চেতনা বা নিজস্ব মতবাদের পরিপন্থী হওয়ার কারণে তথ্য ও সত্য গোপন করাকে ইসলামে মহাপাপ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। একজন সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকের দায়িত্ব হলো নির্দ্বিধায় সত্য প্রকাশ করা।
কুরআনের নির্দেশনা হলো: "তোমরা সাক্ষ্য গোপন কোরো না, আর যে তথ্য গোপন করে, নিশ্চয়ই তার অন্তর মহাপাপী।" (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৮৩)

৫. ক্রোধ বা বিদ্বেষের বশে সত্য পরিহার নয়

সাংবাদিকের কাজ হলো নিরপেক্ষতা বজায় রাখা। ব্যক্তিগত ক্রোধ, আক্রোশ বা অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্য নিয়ে সত্যের পথ ত্যাগ করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
এ বিষয়ে কুরআনে কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়েছে: "কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন কখনো তোমাদেরকে সত্য পরিহারে প্ররোচিত না করে।" (সুরা মায়েদা, আয়াত: ০৮)

৬. মিথ্যা সংবাদ প্রচার: কবিরা গুনাহ ও মিথ্যাবাদী হওয়ার লক্ষণ

রাসূলুল্লাহ (সা.) সত্যের বিকল্প নেই বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি মিথ্যা সাক্ষ্য ও মিথ্যা সংবাদকে অন্যতম কবিরা গুনাহ বা মহাপাপ হিসেবে উল্লেখ করেছেন: "অন্যতম কবিরাহ্... মিথ্যা সাক্ষ্য ও মিথ্যা সংবাদ।" (বুখারি)

এছাড়াও, যাচাই-বাছাই ছাড়া কোনো খবর প্রচার করাকেই মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট বলে ঘোষণা করেছেন তিনি: "মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট, যা শুনবে যাথাই-বাছাই ছাড়া তা-ই প্রচার করবে।" (মুসলিম)

বস্তুত, ইসলাম উৎসাহিত করে সত্যের যথার্থ ও রুঢ় হলেও পরিবেশনকে। মহানবী (সা.) হজরত মুয়াজকে (রা.) দেওয়া আদেশে বলেন, "হে মুয়াজ, তুমি সত্য কথা বলতেই থাকো, যদিও তা রূঢ় ও তিক্ত।" অন্য হাদিসে এসেছে, "অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য উচ্চারণ করাই উত্তম জিহাদ।"

৭. বাক-সতর্কতা: প্রতিটি কথার হিসাব

সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সত্য তথ্যের উপস্থাপন এবং বাকস্পষ্টতা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ইসলাম বিশ্বাস করে যে মন ও মুখের সংশ্লেষহীন বাক্য মূল্যহীন। আল্লাহ তাআলা মানুষকে প্রতিটি শব্দের বিষয়ে সতর্ক করেছেন: "মানুষ যে কথাই বলুক না কেন, তার কাছে একজন দৃষ্টিপাতকারী প্রস্তুত থাকেন।" (সুরা কাফ, আয়াত: ১৮)

এই আয়াত স্মরণ করিয়ে দেয়, সংবাদ লেখা বা প্রচার করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা অপরিহার্য।

ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে, সাংবাদিকতা হলো এক মহান পেশা, যেখানে কলমকে সত্যের পক্ষে এবং ন্যায়ের প্রচারে ব্যবহার করতে হয়। এর প্রধান চালিকাশক্তি হলো আল্লাহভীতি, যা একজন সাংবাদিককে ব্যক্তিগত, দলগত ও পেশাগত সকল প্রকার স্বার্থপরতা থেকে মুক্ত থাকতে সাহায্য করে।

আরও পড়ুন