মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ডিজিটাল অধিকার এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নাগরিক পরিসর এগিয়ে নিতে কাজ করা অধিকারভিত্তিক সংস্থা, ভয়েস, এক আলোচনা সভা আয়োজনের মধ্য দিয়ে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস, ২০২৫ উদযাপন করেছে।
বুধবার (১০ ডিসেম্বর) ঢাকার লালমাটিয়ায়, অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় এর সার্বিক সহযোগিতায় ছিল ইউনেস্কো।
অনুষ্ঠানটি, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে ১৬ দিনের কর্মসূচির পরিসমাপ্তির প্রেক্ষাপটে আয়োজন করা হয়। এতে সাংবাদিক, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, মানবাধিকারকর্মী, নারী, তরুণ ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিগণ অংশগ্রহণ করেন। আলোচনার কেন্দ্রে ছিল বাংলাদেশে বিদ্যমান মানবাধিকার চ্যালেঞ্জ, বিশেষত নারী ও কিশোরীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং জুলাই আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে গনমাধ্যমের সার্বিক অবস্থা।
বিশ্বব্যাপী ১০ ডিসেম্বর পালিত মানবাধিকার দিবস, সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে পালিত হয়। ঘোষনাপত্রটি মনে করিয়ে দেয়- মানবাধিকার কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়, বরং মর্যাদা, সমতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের জন্য অপরিহার্য অঙ্গীকার। অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা আরও জরুরি হয়ে ওঠে। বর্তমানে, ডিজিটাল পরিসরে নাগরিকদের অংশগ্রহণ, ভিন্নমত, সাংবাদিকতা ও অধিকারকর্মীদের সক্রিয়তা ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে, যেখানে নতুন ধরনের সহিংসতা ও দমন-পীড়ন দেখা যাচ্ছে।
এবারের লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে ১৬ দিনের কর্মসূচির প্রতিপাদ্য- ‘সবার আগে নারী ও কিশোরীদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সহিংসতার অবসান’, যা ছিল এই আলোচনার মূল উপজীব্য। অংশগ্রহণকারীরা বলেন, প্রযুক্তিনির্ভর সহিংসতা আজ মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি প্রবেশদ্বার হয়ে উঠেছে। নারীদের ক্ষেত্রে অনলাইন হয়রানি, নজরদারি, হুমকি, ভুয়া তথ্য প্রচার ইত্যাদি, প্রায়ই বাস্তব জীবনে, শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিতে রূপ নেয়, যা ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশের পরিসর, দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত করে।
‘বাংলাদেশে মানবাধিকার অবস্থা পর্যালোচনা: ডিজিটাল সহিংসতা রোধ এবং সাংবাদিকতার নিরাপত্তা’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ভয়েসের উপপরিচালক, মুশাররাত মাহেরা।
তিনি বলেন, ডিজিটাল সহিংসতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা, মর্যাদা এবং নাগরিক জীবনে অংশগ্রহণের অধিকারের সরাসরি লঙ্ঘন। তাঁর মতে, ডিজিটাল সহিংসতার অবসান কেবল ন্যায্যতার দাবি নয়; এটি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও জনগণের তথ্য জানার অধিকার রক্ষার জন্যও অপরিহার্য।
পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ওপর ডিজিটাল আক্রমনের প্রভাব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে নাগরিক উদ্যোগের নাদিরা পারভিন বলেন, ‘ডিজিটাল সহিংসতা আজ নারী ও প্রান্তিক কণ্ঠগুলোকে নিস্তব্ধ করতে অন্যতম কার্যকর অস্ত্র হয়ে উঠেছে। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়া হলে, সহিংসতা মেনে নেয়াকে স্বাভাবিক করে তোলে, যার ফলে নাগরিক পরিসর সংকুচিত হয় এবং জবাবদিহিতা দুর্বল হয়ে পড়ে।’
প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিয়ে মানবাধিকারকর্মী এবং বিশ্লেষক, মঞ্জুর রশিদ বলেন, ‘সাংবাদিকদের সুরক্ষা ও ডিজিটাল সহিংসতা মোকাবিলাকে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার বাধ্যবাধকতা হিসেবে দেখতে হবে। এর জন্য আইনি সংস্কার, জবাবদিহিমূলক প্রশাসন এবং বিভিন্ন খাতের সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি, যাতে প্রযুক্তি গণতন্ত্রকে দুর্বল না করে বরং শক্তিশালী করে।’
ভয়েসের নির্বাহী পরিচালক আহমেদ স্বপন মাহমুদ বলেন, ‘যখন সাংবাদিকদের ওপর হামলা হয় এবং নারীদের কণ্ঠ রোধ করা হয়, তখন পুরো সমাজই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্তমানে গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা আনতে হলে, ডিজিটাল সহিংসতার অবসান ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই।’
নিউজরুমের বাস্তবতা তুলে ধরে উপস্থিত গণপমাধ্যম কর্মীরা বলেন, ‘জুলাইয়ের পর থেকে সাংবাদিকরা, মব হামলা থেকে শুরু করে সমন্বিত অনলাইন অপপ্রচারের মতো নজিরবিহীন ঝুঁকির মুখে পড়েছেন। নারী সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে এ ধরণের আক্রমণ, তাদের পেশাগত গ্রহণযোগ্যতা ধ্বংস করে এবং নাগরিক পরিসর থেকে সরিয়ে দেয়।’
আলোচনায় বক্তারা উল্লেখ করেন যে, সাংবাদিকরা বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি বা অপরাধের প্রতিবেদন করতে গিয়ে শারীরিক হামলা, গণপিটুনি, ইলেক্ট্রনিক সরঞ্জাম জব্দ, হুমকি ও বাধা, যত্র তত্র আটক, সাইবার ও ফৌজদারি আইনের আওতায় বিচারিক হয়রানি এবং ধারাবাহিক অনলাইন হুমকির শিকার হয়েছেন। নারী সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে যৌন হয়রানি, পরিবারের সদস্যদের লক্ষ্য করে আক্রমণ এবং চরিত্রহননের উদ্দেশ্যে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর ঘটনা বেশি দেখা গেছে, যা অনেককে পেশাদারিতে আত্মনিয়ন্ত্রণে যেতে বা দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য করেছে।
অনুষ্ঠানের শেষে সমন্বিত ও অধিকারভিত্তিক উদ্যোগের জন্য যৌথ আহ্বান জানানো হয়। এতে ডিজিটাল সহিংসতাকে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী আইন সংস্কার, সাংবাদিকদের জন্য জেন্ডার সংবেদনশীল সুরক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন, ডিজিটাল নিরাপত্তা ও মানসিক সহায়তা জোরদার করা এবং গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর হামলার জবাবদিহি নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।