দুর্যোগ ঝুঁকিতে বাঁশখালী উপকূল

প্যারাবন উজাড় করে তৈরি হচ্ছে চিংড়ি ঘের

চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এক সময় জলকদর খাল ও সমুদ্র উপকূলজুড়ে ছিল বিশাল প্যারাবন। স্থানীয় চোরাকারবারি ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা চর দখল করে লবণ মাঠ ও চিংড়ি ঘের নির্মাণের ফলে নিমেষে ধ্বংস ও বিলীন হয়ে গেছে বাঁশখালীর অধিকাংশ প্যারাবন।

বঙ্গোপসাগরের জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূল রক্ষার এসব প্যারাবন বিলীন হয়ে যাওয়ায় দুর্যোগ ঝুঁকিতে বাঁশখালী উপকূলের লক্ষাধিক বাসিন্দা। একই সাথে ধ্বংস করা হয়েছে বাঁশখালী উপকূলীয় এলাকার জীববৈচিত্র্য।

জানা যায়, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর বাঁশখালীর উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধ ও চর এলাকার এক হাজার একর জায়গায় প্যারাবন সৃজন করার উদ্যোগ নেয় সরকার ও এনজিও সংস্থা উবিনীগ এবং জাপানি সংস্থা ওয়েস্কা। এর এক বছরের মধ্যে এই সংস্থা দুটি স্থানীয় শ্রমিক ও স্থানীয় শিক্ষার্থীদের নিয়ে বাঁশখালী উপজেলার পুঁইছড়ি, ছনুয়া, শেখেরখীল, চাম্বল, শিলকূপ, গণ্ডামারা, সরল, কাথরিয়া, বাহারছড়া ও খানখানাবাদের উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধ, চর ও জলকদর খালের দুই পাশসহ এক হাজার একরেরও বেশি জায়গায় বাইন ও কেওড়া গাছের বন সৃজন করে। পরবর্তীতে এসব গাছের চারা বড় হয়ে গাছে রূপান্তরিত হয়ে প্যারাবনে রূপ নেয়।

অন্যদিকে ২০০০ সালের পর থেকেই হটাৎ করে উজাড় হতে শুরু হয় উপকূল রক্ষার প্রাণ প্যারাবন। স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠে গাছ চোরাকারবারি। সে সময়ে স্থানীয় প্রভাবশালীরাও বন দখলের পায়তারায় তাদেরকে সহযোগিতা করে। আর চোরাকারবারিরা প্যারাবনের গাছগুলো কেটে স্থানীয় চায়ের দোকান ও বিভিন্ন জায়গায় লাকড়ি হিসেবে বিক্রি করতে লাগল। এ ঘটনায় প্রথমে বন বিভাগের উপকূলীয় রেঞ্জ কর্তৃক কড়াকড়ি থাকলেও তা পরবর্তী ঢিলা হয়ে যায়। এরপর থেকেই প্রভাবশালী স্থানীয় ব্যক্তিদের চর দখল করে লবণ মাঠ ও চিংড়ি ঘের করা, গাছ চোরাকারবারির ফলে নিমেষে ধ্বংস ও নিধনে বিলীন হয়ে যায় এসব প্যারাবন। বর্তমানে তা বেশির ভাগেরই অস্তিত্ব নেই বললেও চলে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী ছনুয়া প্যারাবনের প্রায় কেওড়া ও বাইন গাছ নিধন হয়ে বিলীন হয়ে গেছে। তবে দুই একটা গাছের দেখা মিললেও তা মৃত্প্রায়। অন্যদিকে খুদুখখালী এলাকায় নতুন করে একটি প্যারাবন সৃজন হয়েছে। সেখানকার বেড়িবাঁধ অনেকটা ভালো আছে। তবে গণ্ডামারা, সরল, বাহারছড়া, শিলকূপ ও খানখানাবাদ উপকূলেও প্যারাবন নাই বললে চলে। এসব এলাকার বড় বড় সব প্যারাবন উজাড় হয়ে বিলীন হয়ে গেছে। চিহ্ন পর্যন্ত গায়েব।

খাটখালী মোহনার ছনুয়া অংশ, খানখানাবাদ প্রেমাশিয়া, কাথরিয়ার রত্নপুর এলাকায় ৩টি বড় প্যারাবন রয়েছে। তাতে কিছুটা হলেও উপকূল রক্ষা পাচ্ছে। প্রায় উপকূলীয় এলাকায় প্যারাবন ধ্বংস করে নির্মাণ করা হয়েছে চিংড়ি ঘের , লবণ মাঠ ও বিভিন্ন স্থাপনা। এমন প্রমাণ মিলেছে সরেজমিনে।

স্থানীয়রা জানান, বাঁশখালী উপকূলের প্যারাবনের কয়েক'শ একরের জলাভূমি ইতিমধ্যে দখল হয়ে গেছে। ধ্বংস হয়ে গেছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির আবাসস্থল ও জীববৈচিত্র্য। প্যারাবন ধ্বংসের অপকর্ম লুকাতে চিংড়ি ঘের ও অস্থায়ী বেড়ার ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ ঐতিহ্যবাহী জলকদর খাল দখল বন্ধ, দখলদারদের উচ্ছেদ এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এরপরও প্যারাবন ও খালের দুই পাশের চর দখলবাজি চালানো হয়েছে প্রশাসনের কোনো বাধা ছাড়া। দখলদারদের কেউ কেউ প্যারাবনের জমিকে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি উল্লেখ করে ঘর, লবণ মাঠ ও চিংড়ি ঘেরসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেছেন।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, প্যারাবনের ভেতরে এক ধরনের বেসিনের মত গর্ত তৈরি হয়, যেখানে পানি জমে থাকে। জমে থাকা এসব পানি ভাঙনকে ত্বরান্বিত করে। যেখানে প্যারাবন থাকে সেখানকার মাটি শক্ত হয়। গত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক প্যারাবন নিধন ও ধ্বংস করা হয়েছে। আগের ঘটনায় ব্যবস্থা না নেওয়ায় প্যারাবন নিধন থামছে না। এসব প্যারাবন দখল করে চিংড়ি ঘের, লবণ মাঠ ও জেলেরা ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘর নির্মাণ করেছে। এসব প্যারাবন নিধনের ফলে দুর্যোগ ঝুঁকির মুখে রয়েছে বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী এলাকাগুলো। তবে প্যারাবন ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধেও স্থানীয় প্রশাসন, বন বিভাগ ও বেজা কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতারা।

ছনুয়ার বাসিন্দা আলমগীর বলেন, ছনুয়ায় ৮/৯ বছর আগেও উপকূলবর্তী বড় বড় প্যারাবন ছিল। কিন্তু স্থানীয় গাছ চোরাকারবারি, প্রভাবশালীদের চিংড়ি ঘের নির্মাণ, চর দখল করে লবণ মাঠ করার ফলে নিধন হয়েছে শত শত বাইন ও কেওড়া গাছ। ছনুয়ার স্থানীয় প্রভাবশালীরা সরাসরি এ কাজে জড়িত। প্যারাবন নিধন ও বিলীনের ফলে বর্তমানে বঙ্গোপসাগরের জলোচ্ছ্বাসে প্রায়শই ডুবে যায় ছনুয়া উপকূল। দুর্যোগকালীন সময়ে আতঙ্কে দিন কাটে হাজার হাজার বাসিন্দাদের।

গণ্ডামারার বাসিন্দা ইঞ্জিনিয়ার শাহনেওয়াজ চৌধুরী বলেন, গণ্ডামারা এলাকার বড় বড় প্যারাবনগুলো নিধন ও ধ্বংস  করেছে চোরাকারবারিরা। অল্প টাকায় বিভিন্ন চা দোকানে গাছগুলো লাকড়ি হিসেবে বিক্রি করেছে। চিংড়ি ঘের নির্মাণ করেছে। বন বিভাগের তদারকি না থাকায় তা সহজে করতে পেরেছে চোরাকারবারিরা।

সরলের বাসিন্দা আবু তৈয়ব বলেন, সরলের অধিকাংশ প্যারাবন কেটে লবণ মাঠ ও চিংড়ি ঘের নির্মাণ করেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এক সময় দৃষ্টিনন্দন ঝাউবন ও প্যারাবন ছিল সরল উপকূলে। দুষ্কৃতিকারীরা ঝাউগাছ ও প্যারাবন কেটে সাবাড় করেছে। বন বিভাগ এদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে। এরপরও তাদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না উপকূল। প্যারাবন উজাড় হয়ে যাওয়ায় প্রতিবছর বর্ষায় ভাঙন আরও বেড়ে যায়।

খানখানাবাদ ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম বলেন, উপকূলীয় এলাকার শোভাবর্ধনকারী ঐতিহ্যবাহী ঝাউবাগান ও প্যারাবন যথাযথ পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে। যার কারণে সাগরের জলোচ্ছ্বাস ও দুর্যোগ সময়ে ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয় উপকূলীয় এলাকার। চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে বন বিভাগ ও বেজা কার্যকর ব্যবস্থা না নিলেও শিগগিরই চিরতরে বিলীন হয়ে যাবে অবশিষ্ট ঝাউ বাগান ও প্যারাবন।

বন বিভাগের বাঁশখালী উপকূলীয় রেঞ্জ কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান রাসেল বলেন, যেসব জায়গায় প্যারাবন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, সেসব এলাকায় নতুন করে চারা রোপণ করা হয়েছে, যা ২/৩ বছর পর দৃশ্যমান দেখা যাবে। এছাড়া বেশকিছু জায়গা উদ্ধার করে প্যারাবন ধ্বংসে জড়িতদের বিরুদ্ধে বন আইনে ও থানায় বেশ কিছু মামলা করা হয়েছিল। মামলাগুলো এখনো চলমান। শিগগিরই বাঁশখালী উপকূল নতুনভাবে দৃশ্যমান হবে।