আত্মগোপনে পারদর্শী। খুব সতর্ক পাখি ডাহুক। লেজ ছোট। লেজের নিচের অংশ লালচে আভা সমৃদ্ধ। পিঠের রং ধূসর থেকে খয়েরী-কালো, মাথা ও বুক সাদা। পা লম্বা। ঠোঁট হলুদ, ঠোঁটের উপরে লাল রঙের একটি ছোট দাগ আছে। দেহ কালচে। মুখমন্ডল, গলা, বুক ও পেট সম্পূর্ণ সাদা।
ডাহুকের পুকুর পাড়, খালে জলাভূমি, বিল, নদীর পাড়ের গর্ত তাদের বসবাসের প্রিয় স্থান। কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার ১৭১টি তিতাস নদী, গোমতী, আরচী নদী, বুড়ি নদী, অদের খাল, ডিসি খাল, পুটিয়াজুড়ি খাল, জলাশয় হাওর-বাঁওড়, বিল-ঝিল, ডোবা, নালা, পতিত দীঘি, পুকুর, ঝোপঝাড় কিংবা গাছগাছালি ডালে দল বেঁধে বাস করতো সাদা-কালো এই ডাহুক পাখি।
মুরাদনগরের উত্তরে অদের খাল, ওপাড়ে নবীনগর উপজেলা ডুবাচাইল গ্রামে গত বুধবার (২৩ অক্টোবর) দুপুরে এক মিলাদ মাহফিলের অনুষ্ঠানে বেড়াতে আসা নারায়ণগঞ্জ জেলা রূপগঞ্জে বেড়ীবাঁধ এলাকার ব্যবসায়ী হাসান মীর, সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক) মুরাদনগর উপজেলা শাখা সভাপতি ও মিডিয়া কর্মী আবুল কালাম আজাদ ভূঁইয়া, ডুবাচাইল গ্রামের ডেন্টাল চিকিৎসক মাহমুদুল রহমান সুমন ডুবাচাইল গ্রামের বুজু ফকির বাড়ির সামনে খালে কচুরিপানার উপর দেখতে পান একজোড়া ডাহুক পাখি পাতিহাঁসের সাথে মিলেমিশে পোকা-মাকড় গিলছে। মানুষ শব্দ শুনেই নিমিষেই হারিয়ে যায় ধঞ্চে জমির ভেতরে।
এ সময় রূপগঞ্জের গাউছিয়া মার্কেটে কাপড় ব্যাবসায়ী হাসান মীর ও পিপুড়িয়াকান্দা বাজার ডেন্টাল চিকিৎসক মাহমুদুল রহমান সুমন বলে ওঠে, সামনে দেখেন, নাড়বেন না। আপনার চোখের সামনে একজোড়া ডাহুক আহার করছে। এরা লজ্জাবতী ডাহুক। দূর থেকে দেখে যান, কাছে গেলেই হারিয়ে যাবে। মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে। ঝোপঝাড় ধ্বংসের ফলে ডাহুকের বর্তমান অবস্থা খুব বেশি ভালো নয়। এদের নিরাপত্তা দিতে অবশ্যই বাসস্থান ধ্বংস বন্ধ করতে হবে।
ডুবাচাইল গ্রামের বজলুল রহমান বুজু ফকির ছেলে মো. মহিউদ্দিন ফকির বলেন, আমাদের গ্রামাঞ্চলের ঝোপঝাড় কিংবা গাছগাছালি ও তিতাস নদী পাড় থেকে ডাহুকের কোয়াক কোয়াক হাক-ডাক, শোরগোল এখনও শোনা যায়। গভীর রাতে হঠাৎ ডাহুকের কোয়াক কোয়াক ডাকে অনেকের ঘুম ভাঙে। বর্ষা ও শরতে ডাহুকরা বাড়ির গৃহপালিত হাঁস-মুরগির সঙ্গে বেড়ায়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড.মনিরুল এইচ খান মনে করেন, এই সুন্দর বিপন্ন পাখিটিকে নিরাপত্তা দিয়ে তাদের বাসস্থান রক্ষা করে পরিবেশবান্ধব অবস্থা গড়ে তুলতে পারলে পাখিটির আনাগোনা বাড়ানো সম্ভব।
মুরাদনগর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাক্তার মোহাম্মদ আলী বলেন, বর্ষাকালে এদের প্রজনন ঋতু। এ সময় তারা বাসা করে পানির কাছেই ঝোপঝাড়ের ভেতরে অথবা ছোট গাছের কোপযুক্ত ডালে। নিরাপত্তা ঠিকঠাক থাকলে দীঘির, পুকুরে ঝোপঝাড় পাড়ে নদীর পাড়ের মাটিতেও বাসা করে এই পাখি। ৬-৭টি ডিম দেয় এরা। ডিমের রং ফিকে হলুদ বা গোলাপি মেশানো সাদা। ডাহুক-ডাহুকি মিলে ডিমে তা দেয়। বাচ্চার রং সব সময় হয় কালো। ডিম ফোটে প্রায় ২১ থেকে ২৪ দিনে। আর ৫০ থেকে ৩০ ঘণ্টা পরই বাচ্চারা বাসা ছাড়ে।
মাস তিনেক পরে বাচ্চারা আলাদা জীবন বেছে নেয়। প্রজননের সময় একটি পুরুষ ডাহুক অন্য একটি পুরুষ ডাহুককে সহ্য করতে পারে না। দেখলেই তারা মারামারি করে। ডাহুক পাখি লড়াকু প্রকৃতির। ডাহুকের প্রিয় খাদ্য জলজ পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ। এছাড়া শাপলা-পদ্ম ফুলের নরম অংশ, কচি পানিফল, জলজ শেওলা, লতাগুল্মের নরম অংশ, ধান, কাউন, ডাল, সরিষা, শামুখ, কেঁচো, জোঁক, মাছ, ছোট মাছ, শাকসবজি ও ফল খেয়ে জীবনধারণ করে। ডাহুক পাখিটি বাংলাদেশ, ভারত এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। আবাসস্থল ধ্বংস কারণে খাদ্য সংকট ও প্রজননকালীন সময়ে শিকারিদের উৎপাতসহ নানা কারণে হারিয়ে যাচ্ছে পরিবেশবান্ধব এ প্রজাতির পাখি। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে ডাহুক প্রজাতিটিকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে।