আজ ভয়াল ২২ নভেম্বর, মানিকগঞ্জের ঘিওরের ঐতিহাসিক তেরশ্রী গণহত্যা দিবস। পাক হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসর এবং রাজাকার, আলবদর-আলসামস বাহিনীর সদস্যরা ১৯৭১ সালের এই দিনে বর্বোরচিত নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ঘিওর উপজেলার তেরশ্রী গ্রামের তৎকালীন জমিদার সিদ্ধেশরী প্রসাদ রায় চৌধুরীসহ ৪৩ জন গ্রামবাসীকে গুলি করে এবং বেওনেটের আঘাতে নির্মমভাবে হত্যা করে।
জমিদার সিদ্ধেশরী প্রসাদ রায় চৌধুরীকে হাত-পা বেঁধে শরীরে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আর নিরীহ গ্রামবাসীর উপর বর্বরোচিত হামলা ও হত্যাকাণ্ডের কারণ জানতে চাওয়ায় ঘাতকরা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে তেরশ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমানসহ ৪৩ জন গ্রামবাসীকে। স্বাধীনতার ৫৪টি বছর অতিবাহিত হওয়ার পর নিহতদের পরিবারের কোনো খোঁজ রাখেনি কেউ।
জানা গেছে, তেরশ্রী গ্রামের মানুষগুলো ছিল সাংস্কৃতিকমনা। বাম রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল তেরশ্রী গ্রাম। মুক্তিযোদ্ধাদের আনাগোনা ছিল এ জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর দোসররা টার্গেট করে এই গ্রামটিকে। গোপনে শিক্ষানুরাগী, মুক্তিযোদ্ধা, ভাষা সৈনিক, রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবীদের তালিকা প্রস্তুত করে। নীল নকশা করে এই গ্রামটিকে ধ্বংস করার।
২১ নভেম্বর রাতে এদেশীয় দালালদের নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গোপনে একটি মিটিং করে তেরশ্রী গ্রামে সেনপাড়া কালিবাড়ী প্রাঙ্গণে। তারা পরিকল্পনা করে ২২ নভেম্বর হত্যাযজ্ঞের। ভোর কেটে সূর্য ওঠার মুহূর্তেই হানাদার বাহিনী ও দেশীয় রাজাকার ঘিরে ফেলে তেরশ্রী গ্রামের সেনপাড়ার কালিমন্দিরটি। সিধুঁনগর গ্রামের মধ্য দিয়ে শতাধিক পাকিস্তানি সেনা এদেশীয় ঘাতকদের সহযোগিতায় ভারি অস্ত্র নিয়ে তেরশ্রী গ্রামে যায়। কনকনে শীতের সকালে অনেকেই তখন ঘুম থেকে উঠেনি। ঠিক সেই মূহুর্তে পাকিস্তানি সেনারা অতর্কিত হামলা চালায় গ্রামটিতে। ঘরে ঘরে জ্বালিয়ে দেয় আগুন। ঘর থেকে বের হওয়ার সুযোগ দেয়নি গ্রামবাসীকে।
বৃষ্টির মতো গুলি ছোড়ে তারা নিরীহ গ্রামবাসীর উপর। তাদের চিৎকারে পুরো এলাকা কম্পিত হয়। এ সময় এদেলীয় দালালরা মুখোশ পরে নেয়, যাতে তাদের কেউ চিনতে না পারে। মাত্র ৬ ঘণ্টার অপারেশনে ঘাতকরা একের পর এক বেওনেট চার্জ করে এবং গুলি করে ৪৩ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। বেলা ১২টার মধ্যে হত্যাযজ্ঞ শেষ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঘিওর সদরে চলে যায়। এ সময় পুরো এলাকা রক্তে ভেসে যায়। মরদেহগুলো কোন রকম দাফন করা হয়। তবে সে দিনের সেই নৃশংসতা কিছুতেই তারা ভুলতে পারেনি।
মানিকগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান বলেন, ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি আন্দোলনে তেরশ্রী গ্রামের কৃতিত্ব রয়েছে। তেরশ্রীতে ৪৩ জন শহীদদের স্মরণে দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিদিন অসংখ্য লোকজন স্মৃতিস্তম্ভ দেখার জন্য আসেন। প্রতিদিন যাত্রা পথে বিভিন্ন জেলা-উপজেলারসহ গ্রামীণ জনপদের মানুষ তেরশ্রীতে এমন একটি নান্দনিক স্থাপনা দেখে মুগ্ধ হচ্ছে।
তেরশ্রীর ভয়াল দিনটির স্মরণে আজ সেই শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। ঘিওর উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাশিতা-তুল ইসলামের সভাপতিত্বে এ সময় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক নাজমুন আরা সুলতানা।
আরও উপস্থিত ছিলেন- ঘিওর উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি মো. তানভীর ইসলাম, ঘিওর থানা অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ কোহিনূর মিয়া, উপজেলা প্রকৌশলী মো. শাহিনুজ্জামান, উপজেলা বিএনপির সভাপতি মীর মানিকুজ্জান মানিক, সাধারণ সম্পাদক কাজী ওয়াজেদ আলী মিস্টার, পয়লা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মো. মোশাররফ হোসেন মানিক, জেলার বীর মুক্তিযোদ্ধারাসহ বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতারা।