বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানে পতন হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের। টানা সাড়ে ১৬ বছর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপরিচালনায় যে অনিয়ম, লুটপাট, দুর্নীতি, অর্থপাচার আর অপশাসনের মতো অপকর্মে লিপ্ত ছিল। ঠিক তেমনি ক্ষমতার বলে রংপুর জেলা ভেটেরিনারি হাসপাতালের ভেটেরিনারি কর্মকর্তা ডা. আম্বর আলী তালুকদার বিগত সরকারের কর্তাবাবুদের সন্তুষ্ট রেখে নিজের আখের গুছিয়েছেন।
পাঁচ বছর ধরে অতিরিক্ত দায়িত্বে রংপুর বিনোদন উদ্যান ও চিড়িয়াখানার ভারপ্রাপ্ত কিউরেটর পদেও আছেন তিনি। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে দলীয় ছত্রছায়া থেকে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি করে অর্থবিত্তে প্রভাবশালী হিসেবে নিজেকে পরিচিত করেছেন। সরকারি চাকরি বিধি অনুযায়ী একজন কর্মকর্তা কোন অবস্থাতেই এক স্থানে ৩ বছরের বেশি অবস্থান করতে পারেন না। সেখানে ভেটেরিনারি সার্জন ও চিড়িয়াখানার ভারপ্রাপ্ত কিউরেটর দুটি পদে বহাল তবিয়তে আছেন দীর্ঘ ৫ বছর ধরে। গড়ে তুলেছেন বিলাস বহুল একটি বাড়ি, জমিসহ যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা।
বিশেষ করে আওয়ামী লীগের ছত্রছায়া থেকে যারা বিগত সময়ে 'আঙুল ফুলে কলাগাছ' হয়ে উঠেছেন, তারা রয়েছেন চরম বিপাকে। এমনই এক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা রংপুর বিনোদন উদ্যান ও চিড়িয়াখানার ভারপ্রাপ্ত কিউরেটর ডা. আম্বার আলী তালুকদারকে ঘিরে নানা জল্পনা-কল্পনা তৈরি হয়েছে।
রংপুর বিনোদন উদ্যান ও চিড়িয়াখানার একাধিক সূত্র বলছে, পছন্দের লোককে ইজারা দেওয়া, চিড়িয়াখানায় পশুখাদ্য সরবরাহে অনিয়ম, সরকারি পুকুরে মাছ চাষ, অবৈধভাবে দোকান বসিয়ে ভাড়া আদায়সহ নানা অভিযোগ রয়েছে ডা. আম্বর আলীর বিরুদ্ধে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রংপুর বিনোদন উদ্যান ও চিড়িয়াখানায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সিংহসহ প্রায় ২০০ প্রজাতির প্রাণী আছে সেখানে। প্রতিদিন রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে হাজারো দর্শনার্থী আসেন এখানে। বেশ কিছু পিকনিক স্পট ছাড়াও এখানে রয়েছে শিশুপার্ক, বড় আকারের পুকুর, ভ্রাম্যমাণ হোটেলসহ বিনোদনের নানা আয়োজন।
নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানায়, ভারপ্রাপ্ত কিউরেটর হিসেবে যোগদানের পর একটি প্রতিষ্ঠানকে চিড়িয়াখানার প্রাণীর খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ এবং শিশুপার্কের ইজারা দেন তিনি। এ ছাড়া আগে চিড়িয়াখানার পুকুর ও শিশু উদ্যান লিজ দেওয়া হলেও বর্তমানে আম্বর আলী তালুকদার নিজেই সেগুলো পরিচালনা করছেন। বাঘ-সিংহসহ বিভিন্ন পশুপাখির খাবার সরবরাহ করার টেন্ডারের নামে চলছে হরিলুট কারবার। একেকটা পশুপাখির জন্য যে পরিমাণ খাবার বা মাংসসহ অন্যান্য খাদ্য সরবরাহ করার কথা তার অর্ধেকও সরবরাহ করা হয় না। আর খাবারের মান নিয়ে রয়েছে নানান অভিযোগ। ফলে খাবার, পরিচর্যা ও চিকিৎসার অভাবে একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার, দুটি সিংহসহ অনেক মূল্যবান পশু বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
চিড়িয়াখানা সূত্রে জানা যায়, ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে চিড়িয়াখানার গেট, পার্কিং এরিয়া ও শিশুপার্ক ইজারার দরপত্র আহ্বান করা হলে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা ঘোষণায় সর্বোচ্চ দরদাতা হয় চৌধুরী স্টোর। কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা সুমনা এন্টারপ্রাইজকে ১ কোটি ২ লাখ টাকায় কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এ নিয়ে চৌধুরী স্টোর আদালতের শরণাপন্ন হলে ছয় মাসের স্থগিত আদেশ দেন উচ্চ আদালত। কিন্তু আদালতের আদেশ অমান্য করে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতাকেই ইজারা দেন কিউরেটর আম্বর আলী তালুকদার। নিয়ম লঙ্ঘনের নেপথ্যে তাকে সহযোগিতা করেন বিগত সরকারের কয়েক প্রভাবশালী নেতা।
আদালতের ৬ মাসের নিষেধাজ্ঞা জারির নির্দেশনা অমান্য করে ডা. আম্বর আলী তালুকদার নিজেই লোকবল নিয়োগ দিয়ে চিড়িয়াখানার গেট ও পার্কিং এরিয়ার টাকা উত্তোলন করে পকেটস্থ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রতিদিন লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে ভাগ বাটোয়ারা করে নিচ্ছেন। এ ঘটনায় আদালত অবমাননার অভিযোগ এনেছেন সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠান।
সর্বোচ্চ দরদাতা চৌধুরী স্টোরের প্রতিনিধি হযরত আলী বলেন, সুমনা এন্টারপ্রাইজের চেয়ে ২০ লাখ টাকা বেশি দিয়ে আমরা দরপত্র জমা দিই। কিন্তু কিউরেটর বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের কয়েকজন নেতার প্রভাব খাটিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। দরপত্রে জমা দেয়া আমার সঠিক কাগজপত্রকে ত্রুটিপূর্ণ দেখিয়ে বাতিল করে। পরে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে তার পছন্দের সুমনা এন্টারপ্রাইজকে কার্যাদেশ দেন। যা আইনগত ভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার।
এদিকে রংপুর বিনোদন উদ্যান ও চিড়িয়াখানায় ঘুরতে আসা দর্শনার্থী বায়জীদ মিয়া বলেন, চিড়িয়াখানার নাজুক অবস্থা দেখলে যে কারো মনে নানান রকম প্রশ্ন উঁকি দেবে। আশানুরূপ পশুপাখি নেই। যেসব পশুপাখি আছে সেগুলোও খুব বেশি স্বাস্থ্যবান নয়। পশুগুলোর অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়, এখানে কেমন দুর্নীতি অনিয়ম হচ্ছে। সারা দেশে দুর্নীতিবাজদের বিচার হচ্ছে। সংস্কার করা হচ্ছে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রংপুর চিড়িয়াখানারও সংস্কার খুব প্রয়োজন। যারা দুর্নীতির সাথে জড়িত তাদেরকে আইনের মুখোমুখি করা দরকার।
এদিকে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রংপুর বিনোদন উদ্যান ও চিড়িয়াখানার কিউরেটর ডা. আম্বর আলী তালুকদারের অনিয়ম দুর্নীতির তথ্য ঘুরপাক করছে। জিএম জয় নামে একজন ফেসবুকে বেশকিছু ছবিসহ একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘দেখার কেউ নেই- সরিষার মধ্যে ভূতপ্রেত! রংপুর নগরীর প্রাণকেন্দ্রে বিলাসবহুল বাড়িটি রংপুর চিড়িয়াখানার ডিপুটি কিউরেটর আম্বার আলীর! বর্তমানে কোটি টাকা শতক প্রতি ৫ শতক জমির উপর ৫ তলা বাড়িটি নির্মাণে তার আয়ের উৎস কি? ১৯তম বিসিএস ক্যাডার হিসেবে শুরুতে ৩০-৪০ হাজার টাকা বেতন ছিল! বর্তমানে তার বেতন লাখ টাকা! চাকরি যদি ৩০ বছরও করে থাকেন তারপরও সংসার ও তিন সন্তানের লেখাপড়াসহ মাসিক ব্যয়ভার সামলিয়ে তার কোটি টাকা জমানো অসম্ভব! সবমিলিয়ে আনুমানিক বাড়িটি করতে কমপক্ষে ৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছে! কিভাবে সম্ভব? চিড়িয়াখানার লাগামহীন দুর্নীতির মাস্টারমাইন্ড এই আম্বর আলী!’
আলাউদ্দিনের চেরাগের মতো অভিজাত এলাকায় জমি কিনে ৫ তলা বাড়ি নির্মাণ করার ঘটনায় খোদ প্রাণিসম্পদ বিভাগে তোলপাড় চলছে। তার ১০ কোটি টাকার আয়ের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশিষ্টজনরা।
ফেসবুকের ওই স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রংপুর নগরীর কেরানীপাড়া মহল্লার মৌবনের মোড়ে ৯ শতক জমি কিনে পাঁচতলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন আম্বর আলী। সেখানে একটি ফ্ল্যাটে সপরিবার বসবাস করেন তিনি। বাকি ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া দেওয়া। স্থানীয়রা বলছেন, বর্তমান বাজারমূল্যে আম্বর আলীর বাড়ি ও জমির মূল্য ১০ কোটি টাকার বেশি।
ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংস্কারমূলক কাজ করছে ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যা সাধারণ মানুষের কাছে পেয়েছে গ্রহণযোগ্যতা আর দুর্নীতিবাজদের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে ভীতির কারণ। বর্তমান পরিস্থিতিতে রংপুরের সাধারণ মানুষের দাবি- ডা. আম্বার আলী তালুকদারের মতো কর্মকর্তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে দুদকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীন ভাবে কাজ করুক।
এদিকে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে কথা হয় কিউরেটর আম্বর আলী তালুকদারের সঙ্গে। দীর্ঘ সময় দুই পদে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে কিউরেটর পদে রাখা হয়েছে। আমি তো জোর করে নাই। দুবার বদলি নিয়েছি। তারপরও সরকার আমাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে কিউরেটর রেখেছে। এতে আমার করার কী আছে?’
নগরীর প্রাণকেন্দ্রে বিলাসবহুল বহুতল ভবনের বিষয়ে আম্বর আলী বলেন, ‘২০২০ সালে আমি বাড়ি করেছি। কারও বৈধ টাকা না থাকলে এত বড় বাড়ি করতে পারে? এসব নিয়ে কেন কথা হচ্ছে? চিড়িয়াখানার টাকা দিয়ে আমি বাড়ি করি নাই। নগরীতে আমার কিছু জমি কেনা ছিল সেই জমি বিক্রি করে পাওয়া অর্থ আর ধার দেনা করে বাড়ি নির্মাণ করেছি।’
সর্বনিম্ন দরদাতাকে ইজারা দেওয়ার বিষয়ে আম্বর আলী বলেন, ‘সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্রে ত্রুটি ছিল। এ জন্য দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতাকে কার্যাদেশ দিই। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে, সব মিথ্যা। আমি দুর্নীতি করলে এতদিন রংপুরে থাকতে পারতাম না।’