রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার আলমবিদিতর ইউনিয়নের নগরবন্দ ডাঙ্গি এলাকায় অবৈধ বালু উত্তোলনের ভয়াবহতা এবার প্রাণ কেড়ে নিল দুই নিষ্পাপ শিশুর। বুধবার (৬ আগষ্ট) ওই এলাকায় বালু উত্তোলনের জন্য বসানো লোহার পাইপের গর্তে মিললো দুই শিশুর নিথর দেহ। নিহত মারুফ মিয়া (৭) ভূমিহীন জাকিরুল ও ফুলমতি বেগমের সন্তান এবং আব্দুর রহমান রোমান (৭) আব্দুর রশিদ ও খাদিজা বেগমের পুত্র।
স্থানীয়রা জানান, গত ৫ জুলাই সকাল ৯ টার দিকে শিশু দুটি উত্তোলনকৃত বালুতে পাথর কুড়াতে গিয়ে নিখোঁজ হলে মাইকিং এর মাধ্যমে নিখোঁজের খবর এলাকায় ছড়িয় পড়ে। ওই দিন অনেক খোজাখুঁজির পরও শিশু দুটিকে পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রা নদীতে খুঁজে না পেয়ে ফিরে আসে। সন্দেহ বশত পরের দিন নদীর তীরবর্তী বালু কারবারি আজহারুলের বালু উত্তোলনের গর্তে খুঁজতে যায় এবং সেখানেই মরদেহ দুটি পাওয়া যায়।
স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, পাথর কুঁড়াতে গিয়ে সেখানে কী ঘটেছে যার ফলশ্রুতিতে শিশু মারুফ আরিফের মৃত্যু ঘটে? কীভাবে বাচ্চা দুটি মারা গেছে তার সঠিক তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। তবে অনেকেই বলছেন, পাইপের গর্তে তেমন পানি ছিল না, যেখানে বাচ্চারা ডুবে মারা যাবে। যদি পানিতে পরে মারাই যাবে, তাহলে তাদের মরদেহ মাটির নিচে গেল কিভাবে? মৃত রোমানের গলায় থাকা দড়ি স্থানীয়দের মধ্যে সন্দেহের দানা বেঁধেছে।
এর আগে ২৪ জুলাই একই এলাকায় দিনের আলোয় ফসলি জমির গভীরে লোহার পাইপ বসিয়ে অবৈধভাবে ভূগর্ভস্থ বালু উত্তোলনের সংবাদ স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হলে, বিষয়টি আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা রিটন বালু মহাল আইনে গত ২৬ জুলাই ৩১/২৪৪ নং মামলা দায়ের করেন। দায়েরকৃত মামলায় আজহারুল, শোয়াইব, লাভলু, রবিউল ও আবুল কাশেমকে অভিযুক্ত করা হয়।
কিন্তু আসামিরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় থেমে থাকেনি তাদের অবৈধ বালু উত্তোলন। অভিযুক্ত অবৈধ বালু কারবারিদের গ্রেপ্তার না করে কার্যত তাদের অবৈধ বালু কারবার চালাতে পরোক্ষ সহযোগিতা করেছে থানা পুলিশ।
স্থানীয় এক শিক্ষার্থী বলেন, পুলিশ এসে শুধু টাকা নিয়ে যায়। তাই বালু উত্তোলন বন্ধ হয় না। ফলে এলাকাবাসীর মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে এবং তারা বলছেন, মামলায় অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করা কিংবা বালু উত্তোলন বন্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় আজ নিষ্পাপ শিশু দুটির প্রাণ গেলো। স্থানীয় দেলোয়ার হোসেন বলেন, প্রশাসন অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করলে আজ এই ঘটনা ঘটতো না।
তবে শিশু দুটির মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। তাই সঠিক তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। নগরডাঙ্গী এলাকার আমিনুর ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, আজহারুলসহ কয়েকজন বালু উত্তোলনের পাইপ বসায়। সেই গর্তেই মরদেহ পাওয়া যায়। মৃত রোমানের গলায় থাকা দড়ির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেখানে একটা বাচ্চা মারা গেলে অপর বাচ্চাটি যেন সেই তথ্য ফাঁস করতে না পারে, সেজন্য তাকেও দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে মেরে ফেলে।
আমিনুর ইসলাম বলেন, বাচ্চা নিখোঁজের মাইকিং শুনে আমরা সবাই যখন বাচ্চাদের খুঁজতে যাই, তখন ওরা সবাই বলে এখানে বাচ্চারা আসে নাই, নদীতে নামছে। ওই দিকে খোজেন। অথচ আজহারুলের পাইপের গর্তেই মরদেহ পাওয়া গেল এবং একজনের গলায় দড়ি বাঁধা আছে। আজহারুল কালকেই মেশিন তুলে নিয়েছে।
শিশুর মৃত্যুর খবরে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। অনেকেই অভিযোগ করেন, যদি প্রশাসন সময়মতো কঠোর ব্যবস্থা নিতো, তাহলে হয়তো এই মর্মান্তিক মৃত্যু এড়ানো যেতো।
গঙ্গাচড়া ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের (ভারপ্রাপ্ত) স্টেশন মাস্টার আব্দুল মান্নান বলেন, বালু উত্তোলনের গর্ত থেকে শিশু দুটির মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। একটি মরদেহ পানির নিচে পাওয়া গেলেও অপর মরদেহটি মাটির দুই তিন ফিট নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়। মৃত্যু স্বাভাবিক কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবশ্যই এটা অস্বাভাবিক মৃত্যু।
গঙ্গাচড়া মডেল থানা (ভারপ্রাপ্ত) অফিসার ইনজার্চ আল এমরান বলেন, আলমবিদিতরের দুটি শিশুর মরদেহ পাওয়ার বিষয়ে এখনো মামলা হয়নি। মরদেহ ময়না তদন্তের জন্য পাঠানো হবে। বালু মহাল আইনে দায়েরকৃত মামলায় কেউ গ্রেপ্তার হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, না কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।