রংপুরের তারাগঞ্জের ঘনিরামপুর গ্রামে আজ উৎসবের সাজ। উঠোনে বাঁশে টাঙানো প্যান্ডেল, গেট সাজানো রঙিন কাপড়ে, রান্নাঘরে ধোঁয়া উড়ছে মাংসের হাড়িতে। বরযাত্রীদের জন্য কাটা হয়েছে তিনটি খাসি। বাইরে হাসি-আনন্দের কোলাহল। কিন্তু ঘরের ভেতরটা নিস্তব্ধ বেদনায় ভারী। কারণ আজ যে বিয়ের আয়োজন, সেই বিয়ের দিন ঠিক করতেই তিন মাস আগে প্রাণ হারিয়েছিলেন নূপুর রবিদাসের বাবা রূপলাল দাস।
মাত্র ৪০ বছর বয়সী রূপলাল দাস ছিলেন পেশায় জুতা সেলাইকারী। ফুটপাতের দোকানে দিনরাত পরিশ্রম করে সংসার চালাতেন। স্ত্রী ভারতী রানী, দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে তার ছোট্ট পরিবারই ছিল জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন। বড় মেয়ে নূপুরের বিয়ে ছিল তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের পরিকল্পনা। কিন্তু সেই আনন্দই একরাতে পরিণত হয় মৃত্যুর কালো ছায়ায়।
গত ৯ আগস্ট রাতে জামাই প্রদীপ দাসকে সঙ্গে নিয়ে মেয়ের বিয়ের দিন ঠিক করতে যাচ্ছিলেন রূপলাল। পথেই তারাগঞ্জ-কাজীরহাট সড়কের বুড়িরহাট বটতলায় স্থানীয় কিছু মানুষ ‘চোর’ সন্দেহে তাদের পথরোধ করে। কেউ কিছু না বুঝে ওঠার আগেই শুরু হয় গণপিটুনি। লাঠি, বাঁশ যা পেয়েছে তাই দিয়ে দুজনকে পেটাতে থাকে উত্তেজিত জনতা। একসময় নিস্তেজ হয়ে পড়ে রূপলাল ও প্রদীপের শরীর। রাতের আঁধারে বুড়িরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে ফেলে রাখা হয় তাদের দেহ। হাসপাতালে নেওয়ার পর রূপলালকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। পরদিন ভোরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান প্রদীপ দাসও।
পরদিন, ১০ আগস্ট সকাল। নূপুরের ঘরে হওয়ার কথা ছিল বিয়ের দিন নির্ধারণের আনুষ্ঠানিকতা। কিন্তু উঠোনজুড়ে তখন শোক, কান্না আর আহাজারি।
‘আমার বাবাকে ‘চোর’ বলা হলো, অথচ তিনি নিজের মেয়ের বিয়ের জন্যই যাচ্ছিলেন’ কাঁদতে কাঁদতে বলেন নূপুর রবিদাস।
আজ, ২ নভেম্বর। তিন মাস পর নূপুরের বিয়ের আয়োজন হয়েছে সেই বাবার ঠিক করা বর, রংপুর সদর উপজেলার চন্দনপাটের কমল দাসের সঙ্গে। হিন্দু রীতিতে সব আয়োজন চলছে আলতা, শাঁখা, গহনা, অতিথি আপ্যায়নের প্রস্তুতি। কিন্তু প্রতিটি হাসির ভেতর লুকিয়ে আছে গভীর শোক।
রূপলালের স্ত্রী ভারতী রানী বলেন, ‘স্বামী বেঁচে থাকলে আজ আমাকে ধার-দেনা করে মেয়ের বিয়ে দিতে হতো না। যেভাবেই হোক, মেয়ের বিয়ে দিচ্ছি ওর বাবার শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে। কিন্তু আমার বুকটা খালি হয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী আর জামাইকে পিটিয়ে হত্যা করা হলো, অথচ আজও হত্যাকারীরা মুক্ত। সবাই দেখছে, কিন্তু কেউ কিছু বলছে না।’
বাবা হারানো নবম শ্রেণির ছাত্র জয় রবিদাস এখন পরিবারের অভিভাবক। ‘বাবা নেই, তাই আমাকেই সব করতে হচ্ছে। হাট থেকে খাসি কিনেছি, ঘর সাজানোর জিনিস এনেছি, জামাই বাবুকে উপহার দিতে স্বর্ণের আংটি আর চেইন কিনেছি। ধার করে টাকা জোগাড় করছি। কেউ খোঁজ নেয় না’ বলেন জয়।
বোনের বিয়ের আনন্দের আড়ালে জয় যেন কাঁধে বহন করছে সংসারের সমস্ত ভার। ছোট বোন রূপা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে সে কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে বাবার ছবির দিকে।
তারাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবেল রানা বলেন, ‘নূপুরের বিয়ের জন্য উপজেলা তহবিল থেকে ১ লাখ টাকা, সমাজসেবা অফিস থেকে ১০ হাজার টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি নূপুরের পড়াশোনার জন্য শিক্ষাভাতা, ভারতী রানীর জন্য বিধবাভাতা, আর ছেলে জয়ের জন্য দোকানঘরের বরাদ্দের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
তবে পরিবার বলছে, এসব সাহায্যেও সংসারের ভার টেকে না। বিয়ের খরচের বেশিরভাগই ধার-দেনা করে জোগাড় করতে হয়েছে।
ভারতী রানী বাদী হয়ে তারাগঞ্জ থানায় ৫০০-৭০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে হত্যা মামলা করেছেন। পুলিশ এখন পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু নূপুরের পরিবারের অভিযোগ মূল হোতারা এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
রোববার সকালে ঘনিরামপুর গ্রামে বিয়ের আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিবেশীরা ব্যস্ত সাজসজ্জায়। অতিথিরা আসছেন, রান্নাঘরে গরম ভাতের গন্ধ। তবু রূপলালের ঘরের বাতাসে যেন শোকের গন্ধ লেগে আছে।
বিয়ের সাজে নূপুর বসেছেন কনের আসনে। লাল বেনারসি, গলায় ফুলের মালা সবকিছুই স্বপ্নের মতো। কিন্তু তার চোখে যেন জমে থাকা কান্নার ছাপ।
‘বাবা আজ থাকলে আমার মাথায় হাত রাখতেন। কিন্তু আজ কেউ নেই। আমার বিয়েতে হাসির চেয়ে কষ্টই বেশি’ বললেন নূপুর রবিদাস।
তারাগঞ্জের ছোট্ট ঘনিরামপুর গ্রাম আজ একদিকে আলোয় ভরা, অন্যদিকে শোকে ডুবে আছে। এক পিতা নিজের মেয়ের বিয়ের দিন ঠিক করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। এ যেন পুরো সমাজের বিবেককে প্রশ্ন করে যায়। নূপুরের বিয়ের ঢোল বাজছে, কিন্তু তার প্রতিধ্বনিতে যেন শোনা যায় এক বাবার শেষ নিঃশ্বাসের আর্তনাদ ‘আমার মেয়ে যেন ভালো থাকে।’