শিক্ষক নিবন্ধন সনদের পরিবর্তে সরাসরি পরীক্ষা ও নতুন বিধিমালা

দেশের বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের পদ্ধতিতে আসছে আমূল পরিবর্তন। শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ভিত্তিতে নিয়োগের প্রচলিত ধারা বাদ দিয়ে এখন থেকে এসব প্রতিষ্ঠানে সরাসরি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে পরীক্ষা নেওয়া হবে বিসিএসের আদলে। দুই ধাপের এই পরীক্ষায় থাকছে নির্বাচনী বা বাছাই পরীক্ষা এবং মৌখিক পরীক্ষা।

এই পরিবর্তনের লক্ষ্যে ‘বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা গ্রহণ ও প্রত্যয়ন বিধিমালা ২০২৫’–এর খসড়া তৈরি করেছে সরকার। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক প্রক্রিয়া শেষ করে বর্তমানে খসড়াটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলেই তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হবে বলে আশা করছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৩৮ হাজার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান ২৯ হাজার ১৬৪টি, যেখানে সাড়ে ৫ লাখের বেশি শিক্ষক-কর্মচারী কর্মরত। এতদিন এসব প্রতিষ্ঠানে শূন্যপদের বিপরীতে নিয়োগ প্রক্রিয়া ছিল দীর্ঘ ও জটিল। এ জন্য শিক্ষক হতে প্রার্থীদের প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিবন্ধন সনদ নিতে হতো। পরে এনটিআরসিএ (বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ) গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে শূন্য পদে আবেদন নিয়ে নিয়োগের সুপারিশ করত।

২০০৫ সাল থেকে শিক্ষক নিবন্ধন সনদ দিচ্ছে এনটিআরসিএ। তবে প্রথম ১০ বছর শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা ছিল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির হাতে। ২০১৫ সালের শেষ দিকে প্রতিষ্ঠানটির হাতে নিয়োগের সুপারিশ করার ক্ষমতা আসে। এরপর থেকে ছয়টি গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ১ লাখ ৭৪ হাজার ৫২৫ জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে এনটিআরসিএ।

এনটিআরসিএ চেয়ারম্যান মো. আমিনুল ইসলাম নতুন বিধিমালার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, বিধিমালা জারি হলে নিয়োগ পদ্ধতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। তখন শূন্য পদের বিপরীতে বিজ্ঞপ্তি জারি করে পরীক্ষা নেওয়া হবে। এছাড়া, এতে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা কমবে- বলেন তিনি।

আবার কিছু সূত্র বলছে, নতুন নিয়োগ পদ্ধতি হবে বিসিএসের ধাঁচে। শূন্য পদ উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর আবেদনকারীরা অংশ নেবেন নির্বাচনী পরীক্ষায়। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীরা মৌখিক পরীক্ষায় ডাকা হবেন। এরপর প্রকাশ করা হবে চূড়ান্ত ফল। এনটিআরসিএ কর্মকর্তাদের মতে, পুরো প্রক্রিয়া তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর করার পরিকল্পনা রয়েছে, যাতে মামলা–সংক্রান্ত জটিলতা কমে আসে।

তবে নির্বাচনী পরীক্ষা কীভাবে নেওয়া হবে—লিখিত নাকি এমসিকিউ—তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। কর্মকর্তাদের ধারণা, বিসিএসের বিশেষ নিয়োগ পরীক্ষার মতো এমসিকিউ টাইপ প্রশ্ন হতে পারে। খসড়া বিধিমালায় বলা হয়েছে, নির্বাচনী পরীক্ষার বিষয় ও নম্বর কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবে।

খসড়ার খুঁটিনাটি অনুসারে, নির্বাচনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মধ্যে শূন্য পদের দ্বিগুণ প্রার্থী মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেবেন। মৌখিক পরীক্ষা হবে ২০ নম্বরের। উভয় ধাপে ন্যূনতম ৪০ শতাংশ নম্বর পেতে হবে। মৌখিকের পর প্রকাশিত চূড়ান্ত ফলে শূন্য পদের অতিরিক্ত ২০ শতাংশ প্রার্থীও অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। চূড়ান্ত ফলে উত্তীর্ণদের তিন বছর মেয়াদি সনদপত্র দেওয়া হবে। তবে মেধাক্রম নির্ধারণ হবে কেবল নির্বাচনী পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে।

এনটিআরসিএ চেয়ারম্যান জানান, পরীক্ষার কাঠামো নির্ধারণে অংশীজনদের সঙ্গে একাধিক কর্মশালা আয়োজন করা হবে। সবার মতামতের ভিত্তিতেই নম্বর বণ্টনসহ বিস্তারিত কাঠামো নির্ধারণ করা হবে।

অন্যদিকে, বিষয়টিকে সময়োপযোগী বলছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা। তাদের মতে, এতদিন শিক্ষক নিয়োগে দীর্ঘসূত্রতা, সুপারিশ বা প্রভাব খাটানোর অভিযোগ ছিল। বিসিএসের মতো সরাসরি পরীক্ষা হলে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর একটি বেসরকারি কলেজের এক অধ্যক্ষ বলেন, শিক্ষক নিবন্ধন সনদ নেওয়ার পরও অনেক শিক্ষার্থী বছরের পর বছর নিয়োগ পান না। নতুন পদ্ধতি কার্যকর হলে অন্তত বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী শূন্য পদেই নিয়োগ হবে। এতে শিক্ষক সংকটও অনেকটাই কাটবে।

তবে কিছু প্রার্থী বয়সসীমা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ঢাকা কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও শিক্ষক নিয়োগপ্রত্যাশী রুবেল হোসেন বলেন, বয়সসীমা ৩৫ বছরই থাকছে। কিন্তু নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেরিতে এলে অনেকেই বয়সের কারণে আবেদন করতে পারবেন না। বয়সসীমা নিয়ে আরও নমনীয়তা দরকার।

তবে তিনি মনে করছেন, নতুন পদ্ধতি কার্যকর হলে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হবে। তবে একই সঙ্গে পরীক্ষার কাঠামো ও বিষয়বস্তু প্রণয়নে সঠিক পরিকল্পনা দরকার, যাতে মেধাবী প্রার্থীরা বঞ্চিত না হন।