আইসিইউতে মৃত ব্যক্তিকে রাখা যায় না

হাসপাতালের সবচেয়ে সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোর একটি হলো আইসিইউ (ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিট)। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা রোগীদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও চিকিৎসার জন্যই এই ইউনিট তৈরি।

তবে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে-মৃত ব্যক্তিকে কেন কখনোই আইসিইউতে রাখা হয়? চিকিৎসাবিজ্ঞানে মৃত্যু বলতে বোঝায়-হৃদস্পন্দন, শ্বাস-প্রশ্বাস এবং মস্তিষ্কের কার্যক্রম স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া। এই পর্যায়ে শরীর আর কোনো চিকিৎসা বা যন্ত্রের সাড়া দেয় না।

রোগীর জীবন রক্ষার উদ্দেশ্যে আইসিইউতে বিশেষ সাপোর্ট দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো রোগীর কিডনি সমস্যা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে তাকে ডায়ালাইসিস করতে হচ্ছে, অথবা ফুসফুস যথাযথভাবে অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারছে না এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, তখন আইসিইউতে তাকে নিয়ে বাহ্যিকভাবে সেই অঙ্গগুলো সক্রিয় রাখার ব্যবস্থা করা হয়।

আইসিইউ মূলত এমন রোগীদের জন্য, যাদের জীবনক্রিয়া এখনো বিদ্যমান কিন্তু গুরুতর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

প্রতিটি জীবনচিহ্ন যন্ত্রে ধরা পড়ে

আইসিইউতে রোগীর প্রতিটি জীবনচিহ্ন প্রযুক্তির মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্নভাবে নজরদারিতে থাকে। হৃদস্পন্দন, শ্বাস-প্রশ্বাস, রক্তচাপ, অক্সিজেনের মাত্রা, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের কার্যক্রমও আধুনিক মনিটরের পর্দায় ২৪ ঘণ্টা রেকর্ড হয়। এসব মনিটর কেবল তাৎক্ষণিক তথ্যই দেখায় না, বরং স্বয়ংক্রিয়ভাবে তথ্য সংরক্ষণ করে, যা পরবর্তীতে যাচাই করা সম্ভব।

আইসিইউতে ব্যবহৃত ভেন্টিলেটর, মনিটরিং সিস্টেম, ওষুধ এবং অন্যান্য লাইফ সাপোর্ট যন্ত্র মূলত জীবিত দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে সহায়তা করার জন্য তৈরি। জীবিত দেহে রক্ত সঞ্চালন, অক্সিজেন পরিবহন ও কোষীয় কার্যক্রম চলমান থাকায় এই যন্ত্রগুলো কার্যকর। কিন্তু মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে হৃদস্পন্দন থেমে যায়, অক্সিজেন ও পুষ্টি কোষে পৌঁছায় না, এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই মস্তিষ্কের কার্যক্রম স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়।

চিকিৎসক, কনসালট্যান্ট ও আইসিইউ বিশেষজ্ঞ ডা.আশরাফ জুয়েল বলেন ‘প্রায় ২০ বছর আইসিইউতে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে বলছি, মৃত্যু গোপন করার সুযোগ নেই। চিকিৎসা একটি প্রমাণভিত্তিক বিজ্ঞান।’
মৃত্যুর পর শরীরে ধীরে ধীরে দৃশ্যমান পরিবর্তন শুরু হয়। ত্বক ঠান্ডা হতে থাকে, কারণ দেহে আর তাপ উৎপন্ন হয় না। পেশি শিথিল হয়, চোখের মণি আলোতে প্রতিক্রিয়া দেখায় না। কিছু সময় পর দেহের নিচের অংশে রক্ত জমতে শুরু করে, যা চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্বাভাবিক মৃত্যোত্তর পরিবর্তন হিসেবে পরিচিত।

কোষীয় স্তরেও গভীর পরিবর্তন ঘটে। কোষে শক্তি উৎপাদন বন্ধ হয়, এনজাইমের কার্যক্রম থেমে যায় এবং ধীরে ধীরে কোষ ভেঙে পড়তে শুরু করে। এই পর্যায়ে কোনো ওষুধ, ভেন্টিলেটর বা লাইফ সাপোর্ট শরীরকে সক্রিয় করতে পারে না, কারণ জীবনধারণের মূল প্রক্রিয়াগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়।

ভেন্টিলেশনে কতদিন রাখা যায়

আইসিইউতে রোগীকে ভেন্টিলেশনে রাখা যায় রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে। সাধারণত রোগী ক্রমশ সুস্থ হয়ে স্বাভাবিকভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে শুরু করলে ১-২ সপ্তাহ পর্যন্ত ভেন্টিলেটরে রাখা হয়। অনেক আইসিইউতে এমন রোগীদের কয়েক দিন পরই ট্রায়াল ভেন্টিলেশন দেওয়া হয়, যাতে ধীরে ধীরে নিজে নিজে শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে পারে।

যদি রোগী স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে অক্ষম থাকে, তবে ভেন্টিলেশন ২ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চালিয়ে যেতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি প্রয়োজন হলে এটি কয়েক মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে ভেন্টিলেশন রাখা হলে শরীরের বিভিন্ন স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়ে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ফুসফুসে সংক্রমণ (ভেন্টিলেটর-অ্যাসোসিয়েটেড নিউমোনিয়া), পেশির দুর্বলতা, শ্বাসনালী ও ফুসফুসের ক্ষতি।

মৃত্যু মানেই জীবনক্রিয়ার স্থায়ী সমাপ্তি

মৃত্যুর পর শরীরে আর কোনো জীবনক্রিয়া অবশিষ্ট থাকে না। আইসিইউর পরিবেশ মৃত্যুকে থামাতে বা ফিরিয়ে আনার কোনো ক্ষমতা রাখে না। সেখানে থাকা যন্ত্রগুলো কেবল জীবিত দেহের কার্যক্রমকে সহায়তা করে, মৃত শরীরে এগুলোর কোনো প্রভাব পড়ে না। তাই চিকিৎসাগতভাবে মৃত ব্যক্তিকে আইসিইউতে রাখা শরীরের অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটায় না। মৃত্যুর পর শরীর আর কোনো চিকিৎসার সাড়া দেয় না। আইসিইউ থাকুক বা না থাকুক, দেহ তখন জীববৈজ্ঞানিক নিয়মেই ধীরে ধীরে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়।

নৈতিকতা ও মানবিকতার দিক থেকে

আইসিইউ একটি সীমিত ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা সম্পদ। এখানে প্রতিটি শয্যা, প্রতিটি যন্ত্র এবং প্রতিটি চিকিৎসাকর্মীর সময় একজন জীবিত ও সংকটাপন্ন রোগীর জন্য অমূল্য। এমন বাস্তবতায় কোনো মৃত ব্যক্তিকে আইসিইউতে রাখা মানে সেই সুযোগ থেকে অন্য একজন বেঁচে থাকার লড়াইয়ে থাকা মানুষকে বঞ্চিত করা। এটি সরাসরি চিকিৎসা নৈতিকতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

আধুনিক চিকিৎসা নীতিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে-যেখানে আর কোনো চিকিৎসাগত উপকার সম্ভব নয়, সেখানে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া অনৈতিক। কারণ চিকিৎসার মূল লক্ষ্য জীবন রক্ষা, কষ্ট লাঘব ও সুস্থতার সম্ভাবনা তৈরি করা। মৃত্যুর পর এই তিনটির কোনোটিই আর কার্যকর থাকে না।

মানবিকতার দিক থেকেও বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। মৃত ব্যক্তির মর্যাদা রক্ষা, পরিবারকে বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ দেওয়া এবং অন্য রোগীর প্রাণরক্ষার সম্ভাবনা তৈরি-সবকিছু মিলিয়ে মৃত ব্যক্তিকে আইসিইউতে রেখে দেওয়া চিকিৎসা ও মানবিক উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই গ্রহণযোগ্য নয়। সূত্র: বিবিসি বাংলা, আমেরিকান লাইব্রেরি অব মেডিসিন, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা