কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশে বিভিন্ন স্থানে স্ক্যাবিস (Scabies) ছড়ানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা এবং সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম চলছে। স্ক্যাবিস (Scabies) বা খোসপাঁচড়া একটি অত্যন্ত সংক্রামক চর্মরোগ, যা Sarcoptes scabiei নামক পরজীবী প্রাণী (mite) দ্বারা সংক্রমিত হয়। এটি ত্বকের সংস্পর্শে দ্রুত ছড়ায় এবং চুলকানি, ফুসকুড়ি ও ত্বকের ক্ষত সৃষ্টি করে।
‘স্ক্যাবিস’ কী ও কীভাবে ছড়ায়?
‘স্ক্যাবিস’ একটি পরজীবীঘটিত চর্মরোগ, যা ‘সারকোপটিস স্ক্যাবিয়া’ নামক ক্ষুদ্র জীবাণুর মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রোগ মূলত আক্রান্ত ব্যক্তির সরাসরি সংস্পর্শে আসা এবং তাদের ব্যবহৃত জামাকাপড়, বিছানা, তোয়ালেসহ অন্যান্য ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুত ছড়ায়।
যেসব স্থানে ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশ বিদ্যমান, যেমন বস্তি এলাকা অথবা ছাত্রাবাস যেখানে অনেক মানুষ একসঙ্গে বসবাস করে, সেখানে স্ক্যাবিসের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। এছাড়া, যারা ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার অভাব রাখেন, নিয়মিত কাপড় ধোয়া ও গোসল করা থেকে বিরত থাকেন, তাদের শরীরে এই পরজীবী সহজে আক্রমণ করে।
মুরাদনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক আব্দুল্লাহ আল মামুন এ প্রসঙ্গে বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সাধারণত গরমের সময়ে অন্যান্য চর্মরোগের মতো স্ক্যাবিসের প্রকোপও বাড়ে। যদিও এই রোগ সারা বছরই দেখা যায়, তবে গ্রীষ্মকালে এর সংক্রমণ তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে।”
রোগটি সংক্রমণের কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি আরও বলেন, “যেসব স্থানে ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশ বিদ্যমান, যেমন বস্তি এলাকা অথবা ছাত্রাবাস যেখানে অনেক মানুষ একসঙ্গে বসবাস করে, সেখানে স্ক্যাবিসের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। এছাড়া, যারা ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার অভাব রাখেন, নিয়মিত কাপড় ধোয়া ও গোসল করা থেকে বিরত থাকেন, তাদের শরীরে এই পরজীবী সহজে আক্রমণ করে।”
স্ক্যাবিসের লক্ষণ বা উপসর্গ কী?
স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হওয়ার প্রধান ও প্রাথমিক লক্ষণ হলো সারা শরীরে অসহ্য চুলকানি অনুভব করা। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শরীরের বিভিন্ন ভাঁজ যেমন আঙুলের মধ্যবর্তী স্থান, কোমর, ঘাড়, নিতম্ব, যৌনাঙ্গ, হাতের তালু, কবজি, বগলের নিচের অংশ, নাভি এবং কনুইয়ে এই রোগের সংক্রমণ বেশি দেখা যায়।
আক্রান্ত স্থানগুলোতে ছোট ছোট লালচে দানার মতো র্যাশ অথবা ফুসকুড়ি ওঠে, যা অত্যন্ত চুলকায়। এই ফুসকুড়িগুলো থেকে পানির মতো তরল নির্গত হতে পারে। সাধারণত রাতের বেলায় চুলকানির তীব্রতা আরও বাড়ে।
শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “আমরা প্রায়ই দেখি শিশুরা ঠাণ্ডা, কাশি বা জ্বর নিয়ে আসছে, অথচ তাদের শরীরে স্ক্যাবিসের সংক্রমণও রয়েছে। এমনকি নিউমোনিয়া বা ডায়রিয়ার মতো সমস্যা নিয়ে আসা শিশুদের মধ্যেও স্ক্যাবিসের উপস্থিতি পাওয়া যায়।”
অন্যদিকে, পূর্ণবয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে লালচে দানাদার ফুসকুড়ি দেখা গেলেও, পরবর্তীতে সেকেন্ডারি ইনফেকশন হলে জ্বর বা অন্যান্য উপসর্গও পাওয়া যেতে পারে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
চিকিৎসা কী?
চিকিৎসকরা স্ক্যাবিসের চিকিৎসার ক্ষেত্রে দুটি প্রধান পদ্ধতির কথা বলছেন— প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা এবং প্রতিকারমূলক চিকিৎসা। তবে, এই রোগের বিস্তার রোধে সাধারণত প্রতিরোধমূলক পরামর্শের ওপরই তারা বেশি জোর দিচ্ছেন।
শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, স্ক্যাবিসের সংক্রমণ যাতে না হয় অথবা একজনের থেকে অন্যজনে না ছড়ায়, সেই জন্য আমরা মূলত প্রতিরোধমূলক পরামর্শগুলোই দিয়ে থাকি। কারণ একটি পরিবারের কোনো সদস্য এই রোগে আক্রান্ত হলে খুব সহজেই অন্যদের মধ্যেও তা ছড়িয়ে যেতে পারে। তাই এ বিষয়ে সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি। শুধুমাত্র একজন আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা নিলে চলবে না, যেহেতু এটি ছোঁয়াচে রোগ, তাই পরিবারের সকল সদস্যকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী একযোগে চিকিৎসা নিতে হবে।
পরামর্শ
> পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।
> গরম পানি দিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে গোসল করতে হবে।
> সাবান দিয়ে গোসল করার পর শরীর ভালো করে মুছে শুকাতে হবে।
> চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গলা থেকে পা পর্যন্ত শরীরের সব জায়গায় লোশন বা ক্রিম লাগাতে হবে। এরপর ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা পর আবার সাবান দিয়ে গোসল করতে হবে। এক সপ্তাহ এভাবে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী মুখে খাওয়ার ওষুধ খেতে হবে।
> রোগীর বিছানার চাদর, বালিশের কভার, গামছা- তোয়ালেসহ ব্যবহৃত অন্যান্য কাপড় নিয়মিত গরম পানিতে ফুটিয়ে পরজীবী-মুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে পোশাক আয়রন করে নিতে হবে। কারণ জীবাণুগুলো কাপড়ে লেগে থেকে সংক্রমণ ঘটায়।
> ঘর-বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা।
> যেসব খাবার খেলে রোগীর অ্যালার্জি হয়, সেসব এড়িয়ে চলতে হবে।
> স্ক্যাবিস আক্রান্ত ব্যক্তিকে পুষ্টিকর খাবার ও ফলের রস খেতে হবে।
> প্রচুর পরিমাণে পানি পান ও তরল খাবার বেশি খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
> রোগ সেরে যাওয়ার পরও রোগীর ব্যবহৃত জিনিসপত্র এভাবে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
> শরীরে পানিশূন্যতা না হলে চর্ম রোগ কম হয় বলে চিকিৎসকরা আক্রান্তদের সুষম ও তরল খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
ছোঁয়াচে রোগ স্ক্যাবিসের সংক্রমণ এড়াতে অথবা প্রতিরোধ করতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন করার ওপর জোর দিয়েছেন চিকিৎসকরা। একইসঙ্গে, সুস্থ ব্যক্তিদের আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা আরও জানিয়েছেন, আক্রান্ত ব্যক্তির পোশাক, বিছানা এবং সাবানসহ ব্যক্তিগত ব্যবহারের যেকোনো জিনিস ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা উচিত। পরিবার অথবা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় একজন ব্যক্তি স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হলে অন্যদেরও এই রোগে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। এই কারণে, কোনো একজন আক্রান্ত হলে তার সংস্পর্শে থাকা সকলেরই একযোগে চিকিৎসা শুরু করার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
যদি এই রোগটিকে গুরুত্ব না দেওয়া হয় এবং সেকেন্ডারি ইনফেকশন হয়, সেক্ষেত্রে যথাযথ চিকিৎসা না নিলে এটি ধীরে ধীরে কিডনিকেও আক্রান্ত করতে পারে এবং কিডনি ড্যামেজ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিপদটা এখানেই। যদিও এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া, তবে এর খারাপ দিক এটাই। এজন্য যখন কোনো রোগী আমার কাছে আসে, তখন আমি প্রাথমিকভাবে তার কিডনি পরীক্ষা করে দেখি।
ডা. মাশিউল আলম হোসেন, চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ
চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মাশিউল আলম হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, এই পরজীবী (সারকোপটিস স্ক্যাবিয়া) যখন শরীরে প্রবেশ করে, তখন এর লক্ষণ প্রকাশ পেতে দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এই সময়ে আক্রান্ত ব্যক্তি সংক্রমিত থাকা সত্ত্বেও তা টের পান না। এখানেই মূল সমস্যাটি। আর এই কারণেই যখন কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হন, তখন তার আশেপাশে থাকা সকলেরই দ্রুত চিকিৎসা শুরু করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
ডা. হোসেন আরও জানান, এই রোগের শুরুতে সচেতন না হলে সেকেন্ডারি ইনফেকশনের কারণে অনেক সময় কিডনির জটিলতাও দেখা দিতে পারে।
তিনি বলেন, যদি এই রোগটিকে গুরুত্ব না দেওয়া হয় এবং সেকেন্ডারি ইনফেকশন হয়, সেক্ষেত্রে যথাযথ চিকিৎসা না নিলে এটি ধীরে ধীরে কিডনিকেও আক্রান্ত করতে পারে এবং কিডনি ড্যামেজ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিপদটা এখানেই। যদিও এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া, তবে এর খারাপ দিক এটাই। এজন্য যখন কোনো রোগী আমার কাছে আসে, তখন আমি প্রাথমিকভাবে তার কিডনি পরীক্ষা করে দেখি।
এই প্রেক্ষাপটে, স্ক্যাবিসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সচেতনতা এবং দ্রুত চিকিৎসার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।