বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী প্রাণী কোনো বাঘ, সিংহ বা হাঙর নয় মশা। ডেঙ্গু, ওয়েস্ট নাইল, জিকা, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া এবং লিম্ফাটিক ফাইলেরিয়াসিসের মতো ভয়াবহ রোগ ছড়িয়ে প্রতি বছর লাখো মানুষের প্রাণ কাড়ে এই ছোট্ট পতঙ্গটি। মশাবাহিত রোগে বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি, এবং এই সংকট মোকাবিলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (CDC) কাজ করছে বৈজ্ঞানিক নেতৃত্ব নিয়ে।
২০২৩ সালে বিশ্বজুড়ে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন প্রায় ২৬৩ মিলিয়ন মানুষ, এবং মৃত্যু হয়েছে ৫ লক্ষ ৯৭ হাজারের বেশি মানুষের। বিশ্বের প্রায় ৩.২ বিলিয়ন মানুষ এই রোগের ঝুঁকিতে রয়েছেন।
২০০০ সাল থেকে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে CDC ও তার আন্তর্জাতিক অংশীদারদের উদ্যোগে ১২ মিলিয়নের বেশি প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হয়েছে, এবং ২ বিলিয়নের বেশি সংক্রমণ ঠেকানো গেছে।
এই প্রচেষ্টায় CDC-এর মূল ভূমিকা ছিল
- পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন
- রোগ নজরদারি
- ল্যাব সাপোর্ট ও মশা নিয়ন্ত্রণ
- জাতীয় ম্যালেরিয়া প্রোগ্রামগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি
তবে ম্যালেরিয়া নির্মূলে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে ওষুধ ও কীটনাশকে মশার প্রতিরোধ ক্ষমতা, আনফিলিস স্টেফেনসাই (An. stephensi) নামক আক্রমণাত্মক মশার বিস্তার, চরম আবহাওয়া, ও সীমিত ডায়াগনস্টিক সুবিধা এসব প্রতিবন্ধকতার মধ্যে অন্যতম।
২০২৩ সালে, প্রথমবারের মতো ২০ বছর পর, যুক্তরাষ্ট্রেই দেখা দেয় স্থানীয়ভাবে ছড়ানো ম্যালেরিয়ার কেস। ফ্লোরিডা, টেক্সাস, মেরিল্যান্ড ও আরকানসাসে মোট ১০ জন আক্রান্ত হন। দ্রুত শনাক্তকরণ ও প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে CDC এবং স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ এই সংক্রমণ সীমিত রাখতে সাহায্য করে।
নগর এলাকায় টিকে থাকা এবং ইনসেক্টিসাইড প্রতিরোধী An. stephensi মশা ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে বৈশ্বিক লড়াইয়ে নতুন বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই মশা সহজে শনাক্ত করা যায় না। এ সমস্যার সমাধানে CDC উদ্ভাবন করেছে 'CLASS Assay' নামক একটি পোর্টেবল, সহজ এবং কম-টেকনোলজি নির্ভর টুল, যা জটিল ল্যাব ছাড়াও যেকোনো স্থানে ব্যবহার করা সম্ভব।
এই পরীক্ষণ পদ্ধতি দ্রুত ও নির্ভুলভাবে An. stephensi শনাক্ত করতে পারে, যা বিভিন্ন দেশের জাতীয় ম্যালেরিয়া কর্মসূচিকে সাহায্য করছে সংক্রমণ পর্যবেক্ষণ ও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিতে।
অন্যান্য মশাবাহিত রোগ
ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস (West Nile)
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর প্রায় ২,০০০ জন এই রোগে আক্রান্ত হন, যার মধ্যে ১,২০০ জনের বেশি গুরুতর অসুস্থ হন, এবং ১০০ জনের বেশি মারা যান। এটি যুক্তরাষ্ট্রে মশাবাহিত শীর্ষ রোগ হিসেবে বিবেচিত।
ডেঙ্গু
বিশ্বের প্রায় ৪ বিলিয়ন মানুষ এমন এলাকায় বসবাস করেন যেখানে ডেঙ্গুর ঝুঁকি রয়েছে। এটি আফ্রিকা, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে ব্যাপকভাবে ছড়ায়।
চিকুনগুনিয়া
১০০টিরও বেশি দেশে এই ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা গেছে। বর্তমানে অনেক দেশে এটির সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে।
জিকা
গর্ভাবস্থায় সংক্রমিত হলে গভীর জন্মগত ত্রুটি সৃষ্টি করতে পারে। জিকা ভাইরাস আফ্রিকা, আমেরিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ছড়িয়েছে।
লিম্ফাটিক ফাইলেরিয়াসিস (LF)
এই পরজীবী রোগে আক্রান্ত হলে দেহ বিকৃতি ও স্থায়ী অক্ষমতা দেখা দেয়। বর্তমানে ৪৪টি দেশে প্রায় ৫১ মিলিয়ন মানুষ LF আক্রান্ত।
একটি ছোট মশা বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের জীবনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে। এই বাস্তবতায় CDC ও এর বৈশ্বিক অংশীদাররা কাজ করছে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সচেতনতাকে সামনে রেখে। মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে ব্যক্তিগত সতর্কতা এবং স্বাস্থ্য বিভাগগুলোর উদ্যোগই পারে আমাদের রক্ষা করতে।