কোরবানির মাংস সংরক্ষণ করবেন যেভাবে

দুয়ারে কড়া নাড়ছে মুসলানদের দ্বিতীয় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। আর ঈদুল আজহা মানেই পশু কোরবানি দেওয়া। ঈদুল আজহা মূলত মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু কোরবানি করা হয়ে থাকে। কোরবানির মাংস তিন ভাগ করা হয়। এক ভাগ গরিবদের, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনদের ও এক ভাগ নিজের জন্য। পশু কোরবানির পর নিজের ভাগের অংশের মাংস কমবেশি সবাই সংরক্ষণ করে থাকেন।

বিভিন্ন উপায়ে কোরবানির মাংস সংরক্ষণ করা যায়। তবে এমনভাবে সংরক্ষণ করতে হবে, যাতে এর স্বাদ ও পুষ্টিগুণ বজায় থাকে। মাংস সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ফ্রিজে রাখাটাই সবার প্রথম পছন্দ। তবে ফ্রিজিং করার ক্ষেত্রেও আছে নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম। জেনে নিন মাংস সংরক্ষণের কয়েকটি উপায় ও কিছু টিপস।

চার থেকে ছয় মাস গরুর কাঁচা মাংস ফ্রিজে রাখা যেতে পারে।  কারণ, চার-ছয় মাস পর মাংসের পুষ্টিগুণ, গুণগতমান কমতে থাকে। তবে ফ্রিজের তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি ফারেনহাইটে থাকলে মাংস প্রায় এক বছর পর্যন্ত রাখা যাবে। ফ্রিজে গরুর মাংস পাঁচ থেকে ছয় মাস, খাসির মাংস চার থেকে পাঁচ মাস পর্যন্ত রাখা যায়। তবে কলিজা বেশি দিন ফ্রিজে না রাখাই ভালো। এছাড়া উট, মহিষ তিন থেকে চার মাস রাখা যাবে। আর ভেড়া রাখা যাবে দুই থেকে তিন মাস। 

ফ্রিজে রাখার আগে
মাংস বাসায় এনে ভালো করে ধুয়ে রক্ত ও অন্যান্য ময়লা পরিষ্কার করে নিতে হবে। যে স্থানে এবং যে পাত্রে মাংস বণ্টন ও পরিষ্কার করা হবে সে স্থানে অন্য কোনো খাবার, সবজি রাখা যাবেনা। নয়তো ক্রস কনটামিনেশন হতে পারে। মাংসের রক্ত লেগে থাকলে তা থেকে বাজে গন্ধ হতে পারে এবং মাংসে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে পারে।

ইলেকট্রিসিটি না থাকলে
মাংস ফ্রিজে রাখার এক সপ্তাহের মধ্যে বাসায় ইলেকট্রিসিটি না থাকলে খুব একটা ফ্রিজ খুলবেন না। এতে মাংস শক্ত হওয়ার আগেই বাতাস লাগলে বেশি দিন ভালো থাকবে না।

রান্না করা ও কাঁচা মাংস
রান্না করা ও কাঁচা উভয়ের ক্ষেত্রে বিষয়টি একরকম। তবে এগুলোও শূন্য ডিগ্রি ফারেনহাইটে ডিপ ফ্রিজে এক বছর রাখা যাবে। তবে স্বাদ, পুষ্টিগুণ থাকবে না। ফ্রিজে মাংস রাখার ক্ষেত্রে বড় বড় টুকরো করে রাখতে হবে। কারণ, ছোট টুকরোতেও অনেক সময় পানি ও রক্ত জমে থাকে।

৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট
৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার নিচে কাঁচা মাংস ৪ থেকে ৬ দিন রাখা যায়। এছাড়া জিরো ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রার নিচে রাখলে গরুর কাঁচা মাংস ১২ মাস ভালো থাকবে।

প্যাকেটের গায়ে তারিখ লিখুন
মাংস ফ্রিজে রাখার আগে প্যাকেটের গায়ে তারিখ লিখে রাখুন। এতে মাংসগুলো কত দিন সংরক্ষণ করা হয়েছে সেটা সহজেই বোঝা যাবে।

তাপমাত্রা
ফ্রিজে মাংস রাখার ক্ষেত্রে তাপমাত্রা ঠিক আছে কি না সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যে তাপমাত্রায় মাংস সব সময় বরফ থাকবে সেই তাপমাত্রা সেট করে তারপর মাংস রাখতে হবে।

প্লাস্টিকের ব্যাগ
মাংস অবশ্যই প্লাস্টিকের ব্যাগে বা অ্যালমোনিয়াম ফয়েলে রাখতে হবে। প্লাস্টিকের ব্যাগ বা অ্যালমোনিয়াম ফয়েলে রাখলে বাতাস থাকে না। বাতাস ঢুকলে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে পারে।

ফ্রিজে ছাড়াও কোরবানির মাংস সংরক্ষণের কিছু দারুণ উপায় আলোচনা করা হলো।

লেবু ও লবণের সাহায্যে মাংস সংরক্ষণ 
এ জন্য মাংসগুলো মাঝারি আকারে কেটে হালকাভাবে ছেঁচে নিতে হবে। এরপর লবণ ও লেবুর রসে ঘণ্টা-খানেক ডুবিয়ে রাখার পালা, যেন মাংসের ভেতরে সেটা পৌঁছায়। এভাবে মাংস কয়েকদিন পর্যন্ত ভালো রাখা যায়।

মাংস ভেজে সংরক্ষণ 
মাংস কেটে পরিষ্কার করে আদা বাটা, রসুন বাটা পেঁয়াজ বাটা দিয়ে মাংসটি কিছুক্ষণ ম্যারিনেট করে নিন। এরপর গরম ডুবো তেলে মসলাসহ মাংসগুলো ভেজে  এবং তেল ছেঁকে নিয়ে তা সংরক্ষণ করতে হবে। এর পর একদিন পর পর মাংসগুলো উচ্চতাপে গরম করতে হবে। এভাবে মাংস ১৫ থেকে ২০ দিন পর্যন্ত ভালো থাকে।

আচারের মাধ্যমে সংরক্ষণ 
মাংসের আচার বানানো হলে মাংস দীর্ঘ সময় পর্যন্ত খাওয়া যায় এবং এর স্বাদও অন্যরকম হয়।
পদ্ধতি: প্রথমে মাংসের টুকরোগুলো ভালো করে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিন। পছন্দমতো মসলা দিয়ে মাংস মাখিয়ে নিন। তেল গরম করে মাংসের টুকরোগুলো ভেজে নিন। ভাজা মাংস ঠান্ডা হলে কাচের জারে রেখে তাতে সরিষার তেল ঢেলে দিন, যাতে মাংস ডুবে থাকে। আচার প্রস্তুত হয়ে গেলে এটি ঠান্ডা স্থানে রেখে সংরক্ষণ করুন। এভাবে আচার ছয় মাস পর্যন্ত ভালো থাকে।

শুঁটকি করে সংরক্ষণ 
মাংস শুকিয়ে শুঁটকি বানিয়ে সংরক্ষণ করা যায়। এটি এক ধরনের প্রাচীন পদ্ধতি, যা এখনও প্রচলিত আছে।
পদ্ধতি: প্রথমে মাংস পাতলা ও লম্বা করে কেটে নিন। মাংসের টুকরোগুলো মসলা দিয়ে মাখিয়ে রোদে শুকিয়ে নিন। মাংস পুরোপুরি শুকিয়ে গেলে এয়ারটাইট কনটেইনারে সংরক্ষণ করুন। শুঁটকি মাংস সাধারণত ছয় মাস পর্যন্ত ভালো থাকে।

সসেজ তৈরি করে সংরক্ষণ 
মাংসের সসেজ বিভিন্ন রান্নায় ব্যবহার করা যায় এবং এটি সংরক্ষণ করাও সহজ। প্রথমে মাংস কিমা করে নিন। মসলা ও প্রিজারভেটিভ মিশিয়ে মাংস মেখে নিন। সসেজের খোল তৈরি করে তাতে মিশ্রণটি ভরে দিন। সসেজগুলো ফ্রিজে রাখুন অথবা কড়া রোদে টানা কয়েক দিন শুকিয়ে বাইরে ঝুলিয়ে রাখুন। এভাবে সসেজ তিন-চার মাস পর্যন্ত ভালো থাকে।

ড্রাইং পদ্ধতি
মাংস রোদে বা চুলায় জ্বাল দিয়ে সম্পূর্ণ পানি শুকিয়ে নিতে হয়, এটিকে ড্রাইং পদ্ধতি বলে। সাধারণত লম্বা মালার মতো করে গেঁথে ৬-৭ দিন রোদে শুকিয়ে তারপর এই মাংস সংরক্ষণ করা হয় ৬ থেকে ৭ মাস পর্যন্ত। তবে মাংসে যাতে ফাঙ্গাস না পরতে পারে তার জন্য মাঝেমধ্যে রোদে শুকিয়ে নিতে হবে এবং রান্নার আগে মাংস ২ থেকে ৩ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখবেন। 

কিউরিং সল্ট
মাংসে লবণ দিয়ে ২ থেকে ৩ মাস সংরক্ষণ করা সম্ভব। এই পদ্ধতিতে মাংস সবচেয়ে বেশি ফ্রেশ এবং পুষ্টিগুণসম্পন্ন হয়ে থাকে। এর জন্য সাধারণ লবণ ব্যবহার না করে সুপার শপ থেকে কিউরিং সল্ট কিনে নিতে হবে।

ভিনেগারে ডুবিয়ে সংরক্ষণ
দুই থেকে তিন কেজি মাংস সংরক্ষণের জন্য ৪ টেবিল চামচ বিট লবণ ও ৪ টেবিল চামচ বাদামি চিনি মাখিয়ে নিন প্রথমে। এরপর ১ লিটার ভিনেগারে মাংস পুরোপুরি ডুবানো অবস্থায় ঢেকে রেখে দিন। 

চর্বিতে ডুবিয়ে সংরক্ষণ
এছাড়া চর্বিতে ডুবিয়ে সংরক্ষণ করার পদ্ধতিটি পুরনো। মাংস জ্বাল দিয়ে তারপর চর্বিতে ডুবিয়ে সংরক্ষণ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে মাংসের চেয়ে চর্বির পরিমাণ বেশি হতে হবে।