বাংলা উপন্যাসে প্রথাবিরোধী সম্পর্ক ॥ রকিবুল হাসান

রীতি-বিরুদ্ধ যে মানবসম্পর্ক সমাজ-ধর্মকে তোয়াক্কা না করে সমাজ-ধর্মের ভেতরেই বেড়ে উঠছিল, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেটিকে উপন্যাসের উপজীব্য করে পাঠকের সম্মুখে তুলে আনেন। ‘বিষবৃক্ষ’ ও ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ বাংলা সাহিত্যে এক নতুন বার্তা হয়ে ওঠে। বিধবাদেরও যে আশা-আকাঙ্ক্ষা, কামনা-বাসনা, আবেগ, আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা, ক্ষত-বিক্ষত হৃদয় যে থাকে, বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক যে তাদের জীবনেরও অংশ—তার অসাধারণ রূপায়ণ ঘটান কুন্দনন্দিনী ও রোহিনী চরিত্র সৃষ্টির মাধ্যমে। নগেন্দ্র বিবাহিত জীবনে স্ত্রী সূর্যমুখীকে সুখী জীবন কাটানো অবস্থায় কুন্দনন্দিনী তাদের জীবনে ঢুকে পড়ে। ঢুকে পড়ে বলার চেয়ে বোধ হয় এটা বলাই যৌক্তিক হবে যে, নগেন্দ্র কুন্দনন্দিনীর প্রতি অসম্ভবরকম মুগ্ধ হয়ে কৌশলগতভাবে নিজের জীবনে জড়িয়ে নিয়েছে। যা তাদের সংসার জীবনে বিষবৃক্ষের জন্ম দেয়। যা সমাজজীবনের রীতির বিরুদ্ধে প্রবল একটা ধাক্কাস্বরূপ। যেখানে রূপ লাবণ্য মোহ প্রধান শক্তি হয়ে ধর্ম ও রীতিতে বন্দি স্বামী-অন্তপ্রাণ সূর্যমুখীকে সংসারচ্যুত করেছে, যদিও সে পরে ফিরে এসেছে। কিন্তু বাঁচতে পারেনি কুন্দ।

একই ঘটনা ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসেও ঘটেছে। ভ্রমরের সঙ্গে গোবিন্দলালের যে দাম্পত্যজীবন ছিল, তাতে কোনো সমস্যা ছিল না বরং সুখেরই ছিল। রোহিনীকে কেন্দ্র করে তাদের দাম্পত্যজীবনে ভয়াবহ সংকট ও সমস্যা তৈরি হয়েছে।

গোবিন্দলাল সমাজ-ধর্ম রীতি-নীতি সব ভেঙে তছনছ করে রোহিনীর সঙ্গে থেকেছে। তাকে সেবাদাসী করে রেখেছিল। স্ত্রীর মর্যাদা দেয়নি। শেষপর্যন্ত তাকে হত্যাও করেছে। রূপ ও মোহের কাছে সব ভেঙে পড়েছে। সে সময়ে পরিবার-সমাজ-ধর্মেও বাইরে বেরিয়ে এসে কোনো নারীর সঙ্গে এভাবে অবাধ থাকাটা সহজ বিষয় ছিল না। যেটা গোবিন্দলাল করে দেখিয়েছে। এতে গোবিন্দলালের ভোগবাদী মানসিকতার নগ্ন প্রকাশ ঘটেছে। কিন্তু রোহিনীর স্বপ্ন ছিল একটি সংসার, শুধু শরীরি ভোগ-পিপাসা নয়। সে কারণে রোহিনী গোবিন্দলালের সঙ্গে প্রসাদপুরে গিয়ে থেকেছে। প্রসাদপুরকে একেবারে আলাদা এক ভূখণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা যায়। গোবিন্দলালের সঙ্গে সেখানে স্বামী-স্ত্রীর মতো জীবন ভোগ করলেও বাস্তবে স্বামী-স্ত্রী হতে পারেনি তারা। রোহিনী নিজেকে বিলিয়ে দিয়েও তা লাভ করতে পারেনি। কারণ দুজনের চাওয়া ছিল দুরকমের। একজন পরিবারে বন্দি হতে চেয়েছে স্ত্রীর অধিকারে—পরিপূর্ণ একটি সংসার লাভে বৃহৎজীবনে।

অন্যদিকে, গোবিন্দলাল সম্পূর্ণভাবে ভোগে মত্ত থেকেছে—শরীরলোভী। সেখানে পরিবার-সমাজ-ধর্ম-রীতি-নীতির কোনো ধার ধারেনি সে। কিন্তু তার মনের ভেতরে পুরোটাই থেকেছে ভ্রমর। রোহিনী যখন বুঝতে পেরেছে বাস্তবে গোবিন্দলালকে স্বামী হিসেবে পাওয়া সম্ভব নয়, গোবিন্দলালে সেবাদাসী ভিন্ন সে অন্য আর কিছু নয়, তখুনি সে নিশিকান্তের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে, সেখানেও স্বপ্ন ছিল স্বামী-সংসার। আর এটাই অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে ভোগবাদী গোবিন্দলালের কাছে। যার শাস্তি নির্ধারিত হয়েছে মৃত্যু। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে রোহিনী তার মনের বাসনা স্পষ্ট করে গোবিন্দলালকে জানিয়েছে। কিন্তু গোবিন্দলাল তাতে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে তাকে হত্যা করেছে। সমাজবিরুদ্ধ এ ধরণের উপন্যাসের ভিত মূলত বঙ্কিমের হাতেই প্রথম প্রতিষ্ঠা পায়। যা পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথকেও প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়। তিনি এ ধারাতেই সৃষ্টি করেন জটিল মানবসম্পর্ক ও মনস্তাত্ত্বিকভিত্তিক উপন্যাসে ‘চোখের বালি’।

মনোজাগতিক ব্যাপারটি এখানে ভয়াবহরূপে এসেছে। মস্তিষ্কের কোষে কোষে তা কাজ করেছে। ভয়াবহ মনোদ্বন্দ্ব এ উপন্যাসে প্রমত্ত ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়েছে, কিন্তু তা বাইরে থেকে কিছুই বোঝার উপায় নেই। অথচ ভেতরে ভেতরে ভাঙচুর হয়েছে, মস্তিষ্কের খেলা হয়েছে। আর এসব ঘটছে পরিবারের ভেতর থেকেই। পারিবারিক উপাদানেই। ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে মহেন্দ্র, আশা, বিনোদিনী ও বিহারীর পারস্পরিক মনস্তাত্ত্বিক যে সম্পর্ক একথায় তা অভিনব। পরিবারের ভেতরে থেকেই তাদের মানসিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত-স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্ক্ষা ও আসক্তি-প্রতিশোধপরায়ণতা—সবকিছু চলেছে। কিন্তু বাইরে থেকে কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই। বাংলা সাহিত্যে মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস হিসেবে ‘চোখের বালি’ প্রথম সফল উপন্যাস।

এখানে রবীন্দ্রনাথ সমাজের রীতি-নীতি ভাবনায় বঙ্কিমচন্দ্রের চেয়ে অনেক বেশি দূরদর্শিতা দেখিয়েছেন। ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসেও মধুসূদন ও কুমুর মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারটি যেমন এসেছে, ঠিক তেমনি মধুসূদন কুমুর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ থাকা অবস্থাতেই পরকীয়ায় মত্ত থেকে সমাজ-রীতিকে যেমন ভেঙেছে, তেমনি নীতিকেও গলা টিপে হত্যা করেছে। সেখানে মধুসূদনের ভেতর মূলত কুমুর বাবার পরিবারের সঙ্গে মানসিক এক প্রতিশোধের ব্যাপার ছিল, যার ফলে মধুসূদন কুমুকে অসম্মানিত অবহেলিত ও অবজ্ঞায় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। কুমু কিন্তু মনের সমস্ত পূজার অর্ঘ্য দিয়ে সংসারটা করতে চেয়েছিল। প্রাপ্য সম্মান সেখানে তার জোটেনি।

মধুসূদনের মানসিকতাও কুমু অনুধাবন করতে পারেনি। কারণ মধুসূদন চেয়েছে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে, তার পূর্বপুরুষরা কুমুদের পরিবারে কাজ করতো। সেকারণে কুমুকে বিয়ে করে অত্যাচার করে নীরব প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চেয়েছে নব্যধনী মধুসূদন। এতে তার অসুসস্থ মানসিকতা তীব্ররূপ নিয়েছে। আর একটা ব্যাপার হলো, যারা দরিদ্র থেকে শ্রম-সাধনায় ধনী হয়ে ওঠে তাদেও মধ্যে প্রভুত্ব একটা ব্যাপার চলে আসে। তারা সবকিছুতেই স্বেচ্ছাচারি ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটিয়ে নিজের দখলে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এদেও ভেতর মূল্যবোধ আদর্শ ও নৈতিকতা কাজ করে না। সমাজকেও তারা অর্থের ক্ষমতা খাটিয়ে নিজের অনুকূলে নেয়।

এখানে বলা যেতেই পারে, বঙ্কিমচন্দ্র দ্বারা যেভাবে রবীন্দ্রনাথ প্রভাবিত, ঠিক একইইভাবে রবীন্দ্রনাথ দ্বারা প্রভাবিত হন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি এ আদলেই রচনা করেন নিজেই নিজের বৃত্ত ভেঙে ‘গৃহদাহ’। যা শরৎসাহিত্যে ব্যতিক্রম সাহিত্যকর্ম। এ ধারায় তিনি অন্য আর কোনো উপন্যাস রচনা করেননি। আবার এ ধারাটির এখানেই যবনকিা ঘটেনি।

‘শরৎচন্দ্রের কোনো উপন্যাসে যদি মনন ও হৃদয়াবেগের সমন্বয় হয়ে থাকে, তা হলো গৃহদাহ।’ গৃহদাহ শরৎচন্দ্রের অন্যান্য উপন্যাস থেকে ভিন্নতর এক সৃষ্টি। ব্যতিক্রমও বটে। শরৎ উপন্যাসে যে সব নারী চরিত্র রয়েছে তাদের মধ্যে মূল দ্বন্দ্ব হলো প্রবৃত্তি ও সংস্কারের। এসব চরিত্র কখনোই সংস্কারের প্রাচীর অতিক্রম করতে পারেনি। যেমন ধরা যাক শ্রীকান্তের রাজলক্ষ্মী চরিত্রহীনের সাবিত্রী, পল্লীসমাজের রমা, দেনাপাওয়ার ষোড়শী, পরিণীতার ললিতা ও দত্তÍ বিজয়া। এরা সবাই সংস্কারের কাছে পরাজিত চরিত্র। এক্ষেত্রে একেবারেই ভিন্ন অচলা, গৃহদাহের অচলা। সংস্কারের প্রাচীর ভাঙার চেষ্টা সে করেছে, ভেঙেছেও। প্রবৃত্তির দ্বারা যেমন সে পরিচালিত হয়েছে, তেমনিভাবে সংস্কার ভাঙার দুঃসাহসিকতাও লক্ষণীয়। সমাজ-সংস্কারে বাস করেও, এসবের ভেতর থেকেই সমাজ-সংস্কারকে তুচ্ছজ্ঞান করে নিজের মতো করে নিজেকে এগিয়েছে, নিজের ভবিষ্যৎ—ভালো-মন্দ—নীতি-নৈতিকতা এমনকি পাপ-পুণ্য এসবের তোয়াক্কা করেনি। শরৎ-সাহিত্যে একেবারেই আলাদা এক সত্ত্বাধারী নারী হয়ে-উঠেছে অচলা।

সমাজই বলা হোক, বা জীবন সংক্রান্ত ধ্যান-ধারণার প্রচলিত মানই বলা হোক, এ সমস্ত কিছুর বাঁধন শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি-মানসের নিভৃতে।’ নিষিদ্ধ ভালোবাসা নিয়ে রচিত কালজয়ী উপন্যাসের দৃষ্টান্ত বিদেশি সাহিত্যে অনেক আছে। ‘আনা কারেনিনা’, ‘মাদাম বোভারি’ কিংবা ‘লোডি চ্যাটার্লিজ লাভার’ এখানে উল্লেখযোগ্য। আমাদের সাহিত্যে সফল শিল্প-সার্থক উপন্যাসের স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র। তিনিও নিষিদ্ধ প্রেমকেই উপন্যাসের বিষয়বস্তু হিসেবে গুরুত্ব দিয়েছিলন। এক্ষেত্রে তার ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘বিষবৃক্ষ’ বা ‘চন্দ্রশেখর’ উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ‘কৃষ্ণকান্তের উইলে’ গোবিন্দলাল যে রোহিণীকে ভালোবেসেছিল একথা বহুভাবে উল্লেখ আছে। এ ভালোবাসা সমাজ-বিগর্হিত নিষিদ্ধ ভালোবাসা। আর ধারায় রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ ও ‘নষ্টনীড়ের নাম অবধারিতভাবেই আসে। ‘চোখের বালি’তে বিনোদিনী যে বিহারীকে ভালোবেসেছিল তাওতো নিষিদ্ধ প্রেম।

 রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালির (১৯০৩) প্রভাব ‘গৃহদাহ’-তে রয়েছে। যেমন চোখের বালিতে ‘বিষবৃক্ষ’ ও ‘কৃষ্ণকান্তের উইলে’র প্রভাব আছে। ‘কৃষ্ণকান্তের উইলে’ বিধবা তরুণী রোহিনীর সঙ্গে গোবিন্দলালের বিবাহবর্হিভূত সম্পর্ক, রক্ষিতা করে রাখা, স্ত্রীর মর্যাদা না দেয়া এবং শেষে তাকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু এটি শিল্পসত্ত্বাকে ক্ষুন্ন করা হয়েছে যেমন, তেমনি রোহিনীর নারীহৃদয়ের যে চির চাওয়া স্বামী-সংসার তা হয়ে ওঠেনি—বিধবা হওয়ার কারণে। কিন্তু বিয়ের আশ্বাস দিয়ে তার শরীর সম্ভোগ ঠিকই করেছে গোবিন্দলাল। সমাজ সে-সময় বিধবা-বিবাহ অনুমোদন করবে না বা বিধবা বিবাহ দেওয়ার মতো সাহস ‘নীতিবাদী’ বঙ্কিমবাবু নিজেও দেখাতে পারেননি। তিনিও সমাজ-অনুগত মানসিকতা দেখিয়েই রোহিনীকে হত্যা করে সমাজ রীতি-নীতিকে তুলে ধরেছেন। এক তরুণী বিধবা নারী-হৃদয়ের স্বপ্ন-সাধ মূল্যহীন হয়ে গেছে।

 

পরবর্তী সময়েও এ ধরনের সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে যার মূলে মূলত রয়েছে মানবসম্পর্কের বহুবিচিত্রতা। এ ধরনের রীতিবিরুদ্ধ উপন্যাস মূলত মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের ধ্যান-ধারণাকেই বহন করে। তবে এসব নিয়েও তর্ক করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস বলতে যা বোঝা যায় সেখানে রীতিভাঙার প্রবল শক্তির ঢেউ আছড়ে পড়ে। ফলে এ দুটোকে একসঙ্গে যেমন সহজেই মেলানো যায়, আবার যুক্তিতর্কে এ দুটোর মধ্যেই বিস্তর দূরত্বও আবিষ্কার করা যাবে। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে সারা পৃথিবীতে যে অবক্ষয় তৈরি হয় তার প্রতিফলন ঘটে বাংলা সাহিত্যে কল্লোলগোষ্ঠীর হাতে। তাদের উপন্যাসে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারটি অত্যন্ত সার্থকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। ঔপন্যাসিক ধূর্জটি প্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ত্রয়ী উপন্যাস ‘অন্তঃশীলা’, ‘আর্বত’, ‘মোহন’ নিঃসন্দেহে বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।

মানিক-তারাশঙ্করের উপন্যাসেও মনস্তাত্ত্বিকতা এসেছে গুরুত্বের সঙ্গে। মানবসম্পর্কের বহুমাত্রিকতা এসব লেখকদের উপন্যাসে গুরুত্বের সঙ্গে এসেছে। যেখানে সমাজে রীতি দুমড়েমুচড়ে গেছে। মানিকের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’, তারাশঙ্করের ‘কবি’ ও সতীনাথ ভাদুড়ির ‘জাগরী’ এক্ষেত্রে বড় উদাহরণ। কল্লোলের পরেও এ ধারা প্রবহমান। মানবসম্পর্ক, নিরবচ্ছিন্ন ভাবনাপ্রবাহও মনস্তাত্ত্বিকতা নানাভাবে উপন্যাসের উপজীব্য হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কাঁদো নদী কাঁদো, চাঁদেও অমাবস্যা, গোপাল হালদারের ‘একদা’, ‘অন্যদিন’, ও ‘আর একদিন’, বুদ্ধদেব বসুর ‘তিথিডোর’, শওকত ওসমানের ‘আর্তনাদ’ —এসব উপন্যাসে লক্ষ্য করা যায়।

প্রথাবিরোধী উপন্যাসের কথা যদি স্পষ্ট করে বলা হয় তাহলে সেক্ষেত্রে যে নামটি শক্তভাবে আসে তিনি জগদীশ গুপ্ত। সমকালীন বা গতানুগতিক বিষয়কে গ্রহণ না করে তিনি মানুষের যৌনপ্রবৃত্তি, যৌন বিকারগ্রস্ততা, গণিকাবৃত্তি অনায়াসে উপন্যাসে গল্পের বিষয় করে তার সময়কালে নিন্দিত হয়েছেন। রীতিবিরুদ্ধ ও মনস্তাত্ত্বিকদ্ব›দ্ধ তার উপন্যাসে নতুন মাত্রা লাভ করে। তার ‘অসাধু সিদ্ধার্থ’ ও ‘লঘুগুরু’ উপন্যাস এর বড় দৃষ্টান্ত। পরবর্তীকালে জগদীশ গুপ্তের উপন্যাস নিন্দিত অবস্থা থেকে নন্দিত হতে পেরেছে। বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে রীতিবিরুদ্ধ মানবসম্পর্ক ও মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের বিশেষধারা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতেও অতিক্রম করতে হয়েছে বহুধরনের প্রতিবন্ধকতা। এর পরেও গুরুত্বপূর্ণ আরো অনেক ঔপন্যাসিকই উপন্যাসে রীতিবিরদ্ধ মানবসম্পর্কের গভীর রহস্য উদঘাটনের প্রয়াস গ্রহণ করে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।