কবি ওমর আলীর সবচেয়ে সাড়া জাগানো কাব্যগ্রন্থ ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছে’ (১৯৬০)। এই গ্রন্থটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই পাঠকমহলে যেমন ব্যাপক আলোড়ন তৈরি হয়েছিল, তেমনি বাংলা কাব্যসাহিত্যে ওমর আলীর স্থায়ী আসনটি সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়। এই গ্রন্থটি বাংলা কাব্যধরায় ‘গ্রামজীবননির্ভর আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে।’ বাংলা কবিতায় নানামাত্রিক বাঁক ঘটেছে। প্রথম মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাতেই বাংলা কবিতার আধুনিক যাত্রা ঘটে। এরপর রবীন্দ্রনাথ কবিতায় একক রাজত্ব ও ঐশ্বর্য নিয়ে আসেন। রবীন্দ্রযুগে রবীন্দ্রবৃত্ত ভেঙে কবিতায় নতুন ধারা আনেন নজরুল। অক্ষয়কুমার দত্ত এবং মোহিতলাল মজুমদারও কিছুটা নতুনত্ব সংযোজন করেছিলেন। ত্রিশের কবিরা রবীন্দ্রবৃত্ত ভেঙে কবিতায় এক নতুন ধারা সৃষ্টির চেষ্টা করেন। সেক্ষেত্রে তারা ‘হয়ে উঠেছিলেন নগরমনস্ক’। এই নগরমনস্কতায় তারা শুধু নিজেদের নগরেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নগরযন্ত্রণাকে কবিতায় এনে নতুন এক ধারা নির্মাণের চেষ্টা করেছেন। এই ধারাতেই পরবর্তী কয়েক দশক প্রবাহিত হয়েছে।
গ্রামীণজীবন ও প্রকৃতি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় থাকলেও সম্পূর্ণভাবে ধরা পড়ে জসীমউদ্দীন ও বন্দে আলী মিয়ার কবিতায়। এই দুজনের পরেই বাংলা জীবনযাপন ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে যিনি সম্পূর্ণভাবে কবিতায় ধারণ করেছেন, তিনি ওমর আলী। এক্ষেত্রে ওমর আলী নিজস্ব স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। ‘আধুনিককালের কবিতার মেজাজ-মর্জি সচেতনভাবে ধারণ’ করেই তিনি ‘গ্রামীণ জীবনসংস্কৃতিকে অবলম্বন’ করে কবিতা লিখেছেন। ওমর আলীই একমাত্র কবি যিনি গভীর মমতায় গ্রাম আর গ্রামের মাটিকে কবিতায় গ্রহণ করেছিলেন আপাদমস্তক, বলতে পেরেছেন ‘লোকটা সূতি কাপড় পরেনি, পরেছে শুধু মাটি’। তার সব কবিতাগ্রন্থ গ্রামের নিখাদ গন্ধে ভরা। একইসঙ্গে গ্রামের মানুষের আনন্দ-বেদনা, দুঃসহ জীবন যন্ত্রণাকে খুঁটে খুঁটে দেখেছেন, দেশ-কাল, সমাজ-রাষ্ট্র-স্বাধীনতা, জৈবিকতা-প্রবৃত্তি নানা বিষয় উপজীব্য করেছেন কবিতায়। বেদনার্ত মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তাদের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা নিজের করে পাশে থেকেছেন। তার প্রত্যেকটি কাব্যগ্রন্থই এর সত্যতা বহন করে। এ দেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি, ডাকছে সংসার, হৃদয় ছুয়ে আছে ঝড়, তোমাকে দেখলেই, আমার ভেতর খুব ভাঙচুর হচ্ছে, ফেরার সময়, তেমাথার শেষে নদী, অরণ্যে একটি লোক, ছবি, স্বদেশে ফিরছি, যে তুমি আড়ালে, আমার ভেতর খুব ভাঙচুর হচ্ছে, গ্রামে ফিরে যাই, অরণ্যে একটি লোক, তেমাথার শেষে নদী, আত্মার দিকে, নদী, নরকে বা স্বর্গে, এখনো তাকিয়ে আছি, নিঃশব্দ বাড়ি, ভালোবাসার প্রদীপ, প্রস্তরযুগ তাম্রযুগ, স্থায়ী দুর্ভিক্ষ সম্ভাব্য প্লাবন, লুবনা বেগম, একটি গোলাপ; এভাবে যদি তার সব ক’টি কাব্যের নাম করা যায়; নাম থেকেই দুদণ্ড প্রাণভরে গ্রামের ঘ্রাণ নেওয়া যাবে।
আবার এ গ্রামের পরতে পরতেই যে লুকানো রয়েছে কষ্ট দীর্ঘশ্বাস, যা কবিকে বেদনার্ত করে। গ্রামীণজীবনে সাধারণ দরিদ্র মেয়েরা নানা কারণে যৌবনবতী হওয়ার আগেই তারা কৌমার্য হারিয়ে ফেলে। সমাজের নানারকম হিংস্র ফণা এসব মেয়েদের দিকে ওত পেতে থাকে। সেসব থেকে তারা নিজেদের রক্ষা করতে পারে না। যৌবনপ্রাপ্ত হওয়ার আগেই অনেকে বাল্য বিয়ের শিকার হয়। সেখানে অনাহার অপুষ্টিতে যৌবন আর কোনোদিনই তাদের শরীরে ধরা দেয় না। সমাজে নষ্ট মানুষও আছে। যারা অসহায় মেয়েদের নানারকম প্রলোভন দিয়ে তাদের সঙ্গে শরীরী সম্পর্ক গড়ে তোলে। এসব মেয়েরা শেষ পর্যন্ত প্রতারণার শিকার হয়। কখনো শিকার হয় ধর্ষণের মতো ভয়াবহ ঘটনার। কখনো আবার এসিডে ঝলসে দেওয়া হয়, এসব সরল মেয়েদের শরীর। যৌতুকের নির্মম শিকার হতে হয় এদের। নানামাত্রিক নির্যাতনের জীবন হয়ে ওঠে গ্রামের সহজ সরলা নারীদের। ওমর আলী গ্রামের মানুষ। এই সব তার দেখা। গ্রামের প্রতিটি ধূলিকণা প্রতিটি পায়ের শব্দ তার চেনা। প্রত্যেক নিঃশ্বাসের সঙ্গে তার পরিচয়।
জৈবিকতা বা শরীরী সম্পর্ক কবি অনায়াসে কবিতার অনুষঙ্গ করেছেন। যেটি শুধু মানুষ নয়, প্রাণীমাত্রই অপরিহার্য একটি ব্যাপার। ওমর আলীও সেই অপরিহার্যতাকে অস্বীকার করেননি। বরং অকপটে তা কবিতার শরীরে রূপ দিয়েছেন। বোদলেয়ার, র্যাবো, ম্যুলেন, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, শামসুর রাহমান সবাই কমবেশি জৈবিকতাকে কবিতার অনুষঙ্গ করেছেন। ওমর আলীও এই অনিবার্যতা এড়িয়ে যাননি। বরং অনেক গুরুত্বর সঙ্গেই তিনি কবিতায় জৈবিকতা বা কামগন্ধ-শরীরী বিষয় ধারণ করেছেন।
শব্দ বিন্যাসে ওমর আলী গ্রামীণজীবন আর প্রকৃতি নির্ভর। প্রতিদিনের ব্যবহৃত শব্দ অনিবার্যভাবে গ্রহণ করেছেন তিনি। গ্রামীণ সমাজ-জীবন প্রকৃতির কাছেই কবি বারবার দ্বারস্থ হয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি ঐতিহ্য অন্বেষণে সচেষ্ট ও সচেতন। কবিতায় নানাভাবে তিনি গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যকে ধারণ করেছেন। গাঁয়ের পথ, ঢেঁকির শব্দ, বাঁশঝাঁড়, কলাগাছ, পাখ-পাখালি, ডিঙি নৌকা, পদ্মবিল, পুঁটি, ট্যাংরা, বক, বটগাছ, শরবন, নারিকেল তলা, পুকুর, মুঠো মুঠো শস্য, আবডাল, বুনোলতা, ঘাস, বৃষ্টি, মৃত্তিকা, রোদ, বিটপী ছায়া, বনতল, কফিন, সাতভাই চম্পা, বেড়িবাঁধ, রূপসী মৃগয়া, হাইহিল জুতো,ভাত কাপড়, দেনমোহর, মেঠোফুল-এরকম অজস্র উদাহরণ তাঁর কবিতার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে।
স্বদেশপ্রেম ওমর আলীর কবিতায় একটি প্রধান প্রসঙ্গ। স্বদেশের জন্য কবির ভিতরে গভীর স্বপ্ন যেমন লালিত, আবার স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণাও বিদ্যমান। কবি সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলেও, দেশটা যে রাজনীতির নামে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে, সে-বিষয়ে তিনি সচেতন। অর্থাৎ গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করলেও কবি যে রাজনীতি সচেতন এবং তার ভেতরে যে গভীর দেশপ্রেম রয়েছে তার অনেক কবিতায় তা স্পষ্ট। তার কবিতায় এদেশের মানুষের আত্মপরিচয়, রাজনৈতিক অধিকার, রাজনীতির নামে স্বদেশকে ছিঁড়ে ক্ষতবিক্ষতকরণ, এদেশের দেশপ্রেমী খেটে-খাওয়া মানুষের দুর্বিষহ জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে। সমাজ সময় রাষ্ট্র ও অভিজ্ঞতাকে তিনি কবিতায় গ্রহণ করেছেন। যেখানে তিনি দেশকাল-সমাজ সচেতন কবি। স্বদেশটা যখন নানাভাবে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে, সবকিছু যখন নষ্টের দখলে যাচ্ছে, অনিয়ম ছড়ানো-ছিটানো সবকিছুতে, স্বদেশ- যে স্বদেশ কবির ভালোবাসার-সেই স্বদেশ ‘চিনে বাদামের খোসার মতো সর্বত্র পড়ে আছে পায়ের নিচে’। কবির প্রিয় স্বদেশের মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে বাস করছে। কোনমতো ছেঁড়া শাড়ির আঁচল শরীরে জড়িয়ে থাকে গরিব অসহায় নারীরা। আর তাদের ছেঁড়া আঁচলের ভেতর দিয়ে বের হয়ে আসা যৌবনকে নেকড়ে থাবার খামচে ধরে স্বদেশেরই কোন লম্পট পুরুষ। কবি স্বদেশের এমন রূপ দেখে বেদনাহত।
রক্ত-কান্না-লাশ-সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত প্রিয় এ স্বদেশভূমির করুণ এ অবস্থা কবিকে বেদনা ভারাক্রান্ত ও হতাশাগ্রস্ত করে তোলে। স্বপ্নের কথাও আছে তার কবিতায়। যে স্বপ্ন নিয়ে একদিন এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল। সকলের মতো তিনিও সেই স্বপ্ন দেখেন ‘সংসারের দেউড়ী থেকে পেছনের খিড়কি দুয়ার পর্যন্ত শুধু সুখ’। সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়েই তো এদেশ স্বাধীন হয়েছিল। সুখী-সমৃদ্ধ দেশ অর্জনের জন্যেইতো অনেক রক্ত আর সম্ভ্রমের বিনিময়ে এদেশ কিনতে হয়েছে। কবিও তো এদেশের এক স্বপ্নবান মানুষ। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে সুন্দর সুফল সুখবতী বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন।
ওমর আলী স্বদেশে নানামাত্রিক যে বীভৎসতা দেখেছেন, নষ্ট মানুষদের যে ভয়াবহ দংশন দেখেছেন, নানাধরণের অনিয়ম, বৈরিতা, নিরাপত্তাহীনতা, মৃত্যুর উপত্যকা, নারীর সম্ভ্রমহানী-এসব তাঁকে যন্ত্রণাকাতর করে তোলে। এরকম স্বদেশ তিনি চাননি। তিনি যে সুন্দর ও সুখী-সমৃদ্ধ নিশ্চিন্ত স্বদেশ আশা করেছেন, সে-স্বদেশ বিনির্মাণের জন্যে সাহসী মানুষ এ সময়কালে তিনি স্বপ্ন দেখেন ‘ছোট্ট বুকেও অসীম সাহস আকাশে ওড়ার।’ এ আকাশ সত্য ও সুন্দরের-সত্য ও সুন্দর প্রতিষ্ঠার সাহসে এ আকাশ নির্মিত হবে। কারণ কবি ভালো থাকতে চান কিন্তু কবি জানেন তার চারপাশের অসুস্থ পরিবেশ তাকে কিছুতেই ভালো থাকতে দিচ্ছে না। এই অসুস্থ পরিবেশ দূরীকরণের জন্যে কবি সৎ-সাহসী মানুষের স্বপ্ন দেখেন।
বলা যেতে পারে ওমর আলী ত্রিশের যে স্রোত ত্রিশের সীমানা পেরিয়ে ষাটেও দিব্যি প্রভাব-রাজত্ব বিরাজ করে চলছিল, ওমর আলী সে-ধারা থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে আসা স্বতন্ত্রধারার এক কবি।
প্রত্যেক কবিরক্ষেত্রে কোন না কোন কবির প্রভাব থাকে।সেটি কম-বেশি হতে পারে-কিন্তু তা অস্বীকার করা যায়। মহৎ কবিরা সে-সব প্রভাব থেকে সাধনাগুণে বেরিয়ে নিজস্ব স্টাইল ও ইমেজ তৈরি করে নেন কবিতায়। তখন তাদের কবিতা হয়ে ওঠে স্বতন্ত্র ধারার। মধুসূদনের কাব্য-সাধনায় মিলটন, হোমার, ভার্জিল, দান্তে, ট্যাসো, কীটসের প্রভাব রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের গুরু বলা হয় বিহারীলাল চক্রবর্তীকে। ওয়াডসওয়ার্থ-এর প্রভাবও রয়েছে তার কবিতায়। ভাবের ধারায় লালন শাহ ও গগন হরকরা দ্বারা তিনি বেশ প্রভাবিত হয়েছিলেন। নজরুলের কবিতাতেও শেলি, কীটস, ওয়াল্টার হুইটম্যান-এর প্রভাব লক্ষ করা যায়। জীবনানন্দ দাশের প্রথম দিকের কবিতায় নজরুলের প্রভাব স্পষ্ট। ত্রিশের দশকের কবিদের ক্ষেত্রে টিএস এলিয়ট, র্যাবো, বোদলেয়ার, ম্যুলেন নানাভাবে প্রভাব রেখেছে। শামসুর রাহমানের কবিতায় জীবনানন্দ ও নজরুলের প্রভাব ছিল। যদিও এসব কবি সেসব প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে স্বতন্ত্র কাব্যজগৎ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। ওমর আলীর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তার কবিতাতে জীবনানন্দ দাশের প্রভাব সুস্পষ্ট। কবিতার শরীরি-নির্মাণেও তিনি জীবনানন্দীয় ঢংটি অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবহার করেছেন। যদিও ওমর আলীও জীবনানন্দ-প্রভাববলয় থেকে বেরিয়ে নিজস্ব একটি স্টাইল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সনেট রচনারক্ষেত্রে মধুসূদন তাঁর আদর্শ। জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কবিতা ‘বনলতা সেন’-স্টাইলে ওমর আলীর কিছু কবিতা সহজেই চোখে পড়ে।
ওমর আলরি কবিতায় অনেক নারীর নাম ব্যবহৃত হয়েছে। তাদের রূপের বর্ণনা দিতে গিয়ে গ্রাম-বাংলার প্রকৃতিকেই ব্যবহার করেছেন। গ্রাম-বাংলার নানা উপকরণের সঙ্গে তাদের রূপের তুলনা করেছেন। হাসিনা, জিনিয়া হোসেন, সালেহা, শাহানারা প্রভৃতি নামের উল্লেখ রয়েছে। পুরাণাশ্রিত নায়িকার নামও আছে তাঁর কবিতায়। ওমর আলী যেসব নারীর নাম ব্যবহার করেছেন, তা গ্রামীণ মেয়েদেরই নাম। শহর-নগরের মেয়েদের অতি আধুনিক নাম ব্যবহার তিনি সচেতরভাবেই হয়তো এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু তার কবিতায় যে একাধিক নারীর নাম উল্লেখ আছে, এগুলো একই নারীকে তিনি বিভিন্ন নামে উপস্থাপন করেছেন, নাকি কবির জীবনে এসব নারী স্বতন্ত্র ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন, তার প্রেমিক-মানসস্বরূপটি নির্ণীত হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। যে রহস্যটি রয়ে গেছে জীবনানন্দ দাশের ক্ষেত্রেও। জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় বনলতা সেন, সরোজিনী, সুরঞ্জনা, সুচেতনা, সবিতা, সুদর্শনা প্রভৃতি নারীর নাম ব্যবহার করেছেন। তারা একই নারীর ভিন্ন ভিন্ন নাম, নাকি প্রকৃত অর্থেই তারা স্বতন্ত্র নারী ছিলেন, এ রহস্য আজও অনির্ণীত। বনলতা সেনকে নিয়ে রহস্য আরও গাঢ় অন্ধকার। ওমর আলীর কবিতায় ব্যবহৃত নারীদের নিয়েও এই রহস্য থেকে যাচ্ছে।
ওমর আলী কবি হিসেবেই সমধিক পরিচিত। বাংলা কাব্যসাহিত্যে তিনি জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদদীন ও বন্দে আলী মিয়ার যোগ্য অনুসারী হলেও তিনি নিজস্ব স্টাইল ও ইমেজ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। তার কবিতার বিষয়-বস্তু শব্দ অলঙ্কার বর্ণনায় মৌলিকত্বের শক্ত ছাপ রাখতে পেরেছেন। এ দেশের মাটির নিখাদ গন্ধ বুকে মেখে তিনি কবিতা সৃষ্টি করেছেন। তার কবিতাও হয়ে উঠেছে নিখাদ মাটির গন্ধভরা। ওমর আলী এখানেই অনন্য ও বিশিষ্টতার দাবিদার।কারণ তার কবিতায় ‘অসহ্য সুন্দরের ভেতর প্রকৃত মাটি-মানুষ-ভূমির ক্ষেত্রটি যেমন রচিত তেমনি উন্মুলিত মানুষের মানচিত্রও প্রতিফলিত।’
ওমর আলীর কবিতার বিষয়বস্তু গ্রামীণজীবন-সমাজ ও পরিবেশ নির্ভর হলেও, চেতনাগতভাবে বহুমাত্রিকতা আছে। দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্র-দেশ-কাল-অর্থনীতি-রাজনীতি সবকিছু তার কবিতায় প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা মাটির সঙ্গে থেকেছেন তিনি, মাটির মানুষকে স্পর্শ করে থেকেছেন। তার সময়কালে যেখানে তিনি স্বতন্ত্র। বলা যেতে পারে ওমর আলী ত্রিশের যে স্রোত ত্রিশের সীমানা পেরিয়ে ষাটেও দিব্যি প্রভাব-রাজত্ব বিরাজ করে চলছিল, ওমর আলী সে-ধারা থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে আসা স্বতন্ত্রধারার এক কবি। যেখানে তার দেশ-মাটি-মানুষই প্রধান ও আরাধ্য। তার হাতেই এখান থেকে বাংলা কবিতা আর এক নতুন বাঁক পায়।
