ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

এই মেঘ এই রোদ্দুর ॥ শিল্পী নাজনীন

আপডেট : ২৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৩৪ পিএম

তোমাকে আমি ক্ষমা করে দিলাম। তুমি নিজে পারবে তো নিজেকে ক্ষমা করতে? আয়নার সামনে দাঁড়ালে একবারও কি চোখে পড়বে না মুখোশের আড়ালের ওই ঘৃণ্য মুখ? টেক্সটটা নিপুণকে পাঠিয়ে নিজের ঝাপসা চোখদুটো দূরের আকাশে রাখে মোহনা। আকাশ মেঘলা, তার মনের মতোই আকাশের মুখও অন্ধকারে ছাওয়া, বিষণ্ণ বাদলে থমথমে, গম্ভীর। চোখ মুছে মেসেঞ্জার চেক করে আনমনে। বুকের ভেতরে গভীর কান্না উথলে ওঠে, বান ডাকে নোনাস্রোতের। সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে ফোনস্ক্রিনের দিকে তাকায় আবার। দেখেনি নিপুণ। ইদানীং মোহনার টেক্সট সিন করে না সে। সে এখন দূরতম গ্রহের পিদিম। মোহনার থেকে সহস্র মাইল দূরের এক মহাদেশে সে এখন ব্যস্ততম মানুষ। মোহনাকে তার আর মনে নেই। প্রয়োজনও নেই।

শীলাকে মনে পড়ে। এত দুঃখেও হাসি পায়। শীলা বলতো, শোনরে মোহনা, মানুষরে ভুলেও বিশ্বাস করবি না জীবনে। দুইন্নাতে তাগো মতো ভয়ঙ্কর প্রাণি আর একটাও পাইবি না তুই। মানুষ এমন এক প্রাণি, যারে না কাইটা খাওন যায়, না রাইন্ধা খাওন যায়। গেলে হয়ত বোঝন যাইত হ্যারা তিতা, মিঠা নাকি ঝাল। যায় না যহন তহন তাগোরে বিশ্বাস করবি তা রাম ঠকন ঠকবি, বুজছোস?

শীলার কথা হেসেই উড়িয়ে দিত তখন মোহনা। তাকে নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে হাসাহাসি করত আড়ালে। অথচ শীলাই সত্যি ছিল। জীবনের এই ভয়ঙ্কর চোরাবালিতে দাঁড়িয়ে আজ সেই শীলাকেই মনে পড়ে মোহনার। শীলাকে তাচ্ছিল্য করার পরিণতিটা আজ হাড়ে হাড়ে টের পায়। মানুষ বদলায়। কিন্তু এত দ্রুত? আর এতটাই? 

বুকচেরা এক দীঘল দীর্ঘশ্বাস পুড়িয়ে দিতে চায় মোহনার মনজমিন। ঘটনাটা মনে পড়তেই একরাশ কান্না তাকে এলোমেলো করে দেয় আবার।

নার্স খুবই পেশাদার, কমার্শিয়াল ভঙ্গিতে কাজটা সেরে নিয়ে ঝটপট তাকে বিদায় করার মওকা খুঁজছিল। একজনকে নিয়ে অত নখরা করার ধৈর্য বা সময় কোনোটাই ছিল না তার। তার ছুরি-কাঁচির নিচে নিজের একান্তই অনিচ্ছুক, অপ্রস্তুত শরীর বিছিয়ে মোহনা ছটফট করছিল কাটা মুরগির মতো। অপারেশন টেবিলের দুপাশে শক্ত করে বাঁধা তার দু পা আর উরুর ফাঁকে পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডটি সংঘটনে ব্যস্ত ছিল তখন নার্স। যন্ত্রণায় দিশাহারা মোহনার কাকুতি-মিনতি, চিল-চিৎকার, সমস্ত অগ্রাহ্য করে মধ্যবয়সী নারীটি দ্রতলয়ে তার হাতে থাকা প্রমাণসাইজের সূচালো, ঠাণ্ডা আর ধাতব বস্তুটি মোহনার নিভৃততম প্রদেশে প্রবেশ করিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বের করে আনছিল দলা দলা রক্ত। ভেতরে বেড়ে ওঠা ভ্রুণটিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে বের করে আনতে সে তখন অতিমাত্রায় ব্যস্ত। বাইরে অপেক্ষারত নিপুণের গম্ভীরমুখ মায়ের কড়া নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল সে। নার্স তার পটুত্ব প্রমাণ করে টাকা গুণে নিয়ে পরবর্তী পেশেন্ট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছিল মুহূর্তেই। অতঃপর ট্রেতে দলা দলা রক্তের বিবমিষা জাগানো স্তূপ দেখিয়ে বকশিস আদায় করে হাসিমুখে মোহনাকে নিপুণের মায়ের জিম্মায় দিয়েছিল ওটিতে দায়িত্বরত আয়া। মোহনাকে এরপর একা রিকশায় তুলে দিয়ে নিপুণের মা-ও নিজের পথ মেপেছিলেন পলকেই।
কে দায়ী? মোহনা? তার তো সবে ১৯ তখন। জীবনের হালচাল কী আর বুঝত সে! নিপুণেরও অনার্স ফাইনাল ইয়ার চলছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের একদম শেষ ধাপ প্রায়। ভালোবাসায় মোহনাকে সে জড়িয়ে নিয়েছিল আষ্টেপৃষ্ঠে। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল তার মায়ের সঙ্গেও। নিপুণকে অবিশ্বাসের কোনো কারণই ছিল না তাই আর। গোপনে বিয়ে সারায় নিপুণের সব দাবি সে মেনে নিয়েছিল সহজেই। 

দ্রত ঘটে গেছিল সব। নিজের ভেতরে অন্য আমির অস্তিত্ব টের পেয়েই নিপুণকে জানিয়েছিল মোহনা। আকাশ থেকে পড়েছিল নিপুণ। সব অস্বীকার করে ধোয়া তুলসি পাতাটি সেজে চোখ উল্টে ফেলেছিল সে। অগত্যা নিপুণের মায়ের শরণাপন্ন হয়েছিল মোহনা। সব শুনে মোহনাকে ক্লিনিকে নিয়ে নীরবে আপদ নামিয়েছিলেন তিনি ঘাড় থেকে। রিকশায় তুলে দিয়ে, মোহনার চোখে পড়ে এমনভাবে দয়া করে ভাড়াটাও গুঁজে দিয়েছিলেন রিকশাআলার হাতে। এর তিন মাসের মধ্যেই অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছিল নিপুণ। চেষ্টা চলছিল বহুদিন ধরেই। যাওয়ার আগে আগে আবার মোহনার সঙ্গে ভাব জমিয়ে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছিল সে। দুই বছর পর ফিরেই আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করবে, প্রতিজ্ঞা করেছিল মোহনাকে ছুঁয়ে।

মেসেঞ্জারের আনসিন মেসেজগুলোর দিকে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে পুরোনো কথা ভাবে মোহনা। ঠোঁট তিরতির কাঁপে। 

নিপুণ দেশ ছেড়েছে প্রায় বছরখানেক। অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে প্রথম প্রথম হাই-হ্যালো করলেও আজকাল আর যোগাযোগ করে না সে। মেসেজও সিন করে না এখন। প্রোফাইলে যুগল ছবি দিয়েছে কিছুদিন হলো। নিপুণের মা গর্বভরে জানিয়েছেন প্রবাসী এক বাঙালির মেয়ের সঙ্গে বাকদান হয়েছে নিপুণের। ওখানেই সেটলড হবে সে। গ্রিনকার্ডও মিলবে অচিরেই।

মেসেঞ্জারে নিজের লেখাগুলো অস্পষ্ট, ঝাপসা হয়ে আসে। কেঁচোর মত কিলবিল করতে থাকা অক্ষরগুলোর দিক থেকে চোখ সরিয়ে আকাশে তাকায় মোহনা। আকাশজুড়ে মেঘ। তার ফাঁকে চিলতে আলো উঁকি দিতেই হঠাৎ একটুকরো অন্ধকার এসে ঢেকে দেয় তার সোনালি আভা। মোহনা অন্ধকার আকাশের চোখে চোখ রেখে মনে মনে বলে, আমার ঘৃণাটুকুর যোগ্যও তুমি নও, নিপুণ! প্রকৃতিই তোমাকে তোমার প্রাপ্য বুঝিয়ে দেবে কোনো একদিন। সেদিনের জন্য প্রস্তুত থেকো।

আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়ে মোহনা। ছোট ভাই-বোনদের দায়িত্ব তার কাঁধে। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা সেই কবেই কাঁধ থেকে তাদের নামিয়ে দিয়ে নতুন সংসারে থিতু হয়েছেন। মোহনার ছোট্ট কাঁধে অনেক ভার সইতে হয় এখন। এসব তুচ্ছ মনোভারকে উপেক্ষা করেই তাকে হাটতে হবে জীবনের কাঁটাময় পথ। নিপুণের মতো বরাহশাবকদের সেখানে অত গুরুত্ব দিলে কি চলে!
বাইরে তখন চনমনে রোদ। মেঘ সরিয়ে ঝলমল হেসে উঠেছে স্নিগ্ধ আকাশ।

আরও পড়ুন