ক্ষেত্রগুপ্ত : নির্মোহ সাহিত্য সমালোচক  ॥ জান্নাতুল যূথী

ক্ষেত্রগুপ্ত বাংলা সাহিত্যে প্রবন্ধকার-সমালোচক হিসেবে পরিচিত। তিনি ১৯৩০ সালের ১৭ জানুয়ারি পিরোজপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ২০১০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ৮০ বছর বয়সে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৫৪ সালে কলকাতার চারুচন্দ্র কলেজে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন। ক্ষেত্রগুপ্ত ১৯৪৭ সালে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ওয়েস্ট বেঙ্গল ইনস্টিটিউট অব ফোকলোরের সভাপতি ছিলেন। 

এই প্রতিভাবান লেখকের লেখায় ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্যতত্ত্ব ও দর্শনের নানা দিক বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি মূলত সাহিত্যকে সমাজের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। বাংলা সাহিত্যের দিকপাল রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, মানিক, মাইকেল প্রমুখ সাহিত্যিকের রচনাগুলোকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেছেন। বিশ্লেষণধর্মী ও তীক্ষ্ণ সাহিত্য-সমালোচনার জন্যই তিনি আজও বাংলা সাহিত্যে বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। 

তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো, ‘সমালোচনা’, ‘বাংলা উপন্যাসের ইতিহাস’, ‘প্রাচীন কাব্য-সৌন্দর্য জিজ্ঞাসা ও নবমূল্যায়ন’, ‘মধুসূদনের কবি-আত্মা ও কাব্যশিল্প’, ‘বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস : শিল্পরীতি’, ‘রবীন্দ্র-গল্প : অন্য রবীন্দ্রনাথ’, ‘সংযোগের সন্ধান লোকসংস্কৃতি’ ও ‘বাংলাদেশ : সংস্কৃতি ও সাহিত্য’, ‘কবি মুকুন্দরাম’, ‘কুমুদরঞ্জনের কাব্যবিচার’ ও ‘ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র’ প্রভৃতি। ‘বাংলা সাহিত্যের সমগ্র ইতিহাস’ তার রচিত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এই গ্রন্থেই তিনি বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক ইতিহাস তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন।
 
‘আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে তিনি ‘উনিশ শতকের প্রথমার্ধ : নবজাগৃতির প্রস্তুতি’ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালের উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ-সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। তার বিশ্লেষণধর্মী আলোচনায় স্থান পেয়েছে বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিলগ্নের কথা। ‘পূর্বতন সাহিত্যিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্ক’তে তিনি একালের সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আগে প্রায় আটশত বছরের সাহিত্যিক ঐতিহ্যের কথা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যে-কোনো জাতির ইতিহাসে কোনো যুগে গুরুত্বপূর্ণ যত পরিবর্তনই ঘটুক না কেন পুরোনো কালের সঙ্গে সব যোগ সে হারিয়ে ফেলে না। পুরোনো বলেই তা শেলেটের লেখার মতো সহজে মুছে ফেলবার নয়।’
 
পালপর্ব থেকে আরম্ভ করে ইংরেজ বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক সামন্তবাদ। গ্রাম ও কৃষির ওপর নির্ভর করেই এর বিকাশ লাভ করেছে। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানাবিধ পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে বাংলা সাহিত্যেও বিষয় নির্ধারিত হয়। তবে সেকালীন সাহিত্যের মূল লক্ষণ ছিল অনুকরণ ধর্ম। একটু গভীর দৃষ্টি দিলেই বোঝা যাবে, বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যে বৈচিত্র্যের অভাব রয়েছে। মোটামুটি দুটি ধারাই বাংলা সাহিত্যে প্রচলিত ছিল। পাঁচালী কাব্য আর পদাবলী। সাহিত্য তখন হয় মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গলে নিবন্ধ ছিল নতুবা রামায়ণ-মহাভারত-ভগবতের অনুষঙ্গে কাহিনিবৃত্ত গড়ে উঠেছিল। দ্বিতীয়ত এই সময়ের সাহিত্যে ধর্মের প্রভাব ছিল ব্যাপক। 

মঙ্গলকাব্যে নানা লৌকিক দেবদেবীর মাহাত্ম্যকীর্তন এবং পূজাপ্রচারই লক্ষ্য ছিল। তৃতীয়ত ক্ষেত্রগুপ্ত এই সময়ের সাহিত্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, এ সময়ের সাহিত্যে ভাবোচ্ছ্বাসের আধিক্য ছিল। ভক্তিতে কিংবা প্রীতিতে ভাব প্রকাশ করেছে। উনিশ শতকের আগে সাহিত্যে কবিতার একাধিপত্য ছিল। আদি ও মধ্যযুগের সব সাহিত্য কবিতার ঢংয়ে লেখা। সাহিত্যে গদ্যের ব্যবহার সমকালীন অন্য কোনো ভারতীয় ভাষায় এতটা অপ্রচলিত ছিল না। সাহিত্যের আরেক পর্যায়ে রয়েছে জীবনমুখিতা। ধর্মকে আশ্রয় করে সাহিত্য গড়ে উঠলেও মানবতা প্রকাশে বাধাপ্রাপ্ত হয়নি এসব সাহিত্যে।

 ‘ইংরেজি সংস্পর্শের সাংস্কৃতিক ফলাফল’ প্রবন্ধে ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের জয় হলো এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্রিটিশদের হাতে চলে গেলো। বাঙালি বুদ্ধিজীবী শ্রেণি ইউরোপীয় সংস্কৃতির নিকটবর্তী হলো। মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগের যে সামাজিক-সংস্কৃতিক বিচ্ছেদই নবজাগৃতি নামে অভিহিত করেছেন ক্ষেত্রগুপ্ত। তিনি ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে নবজাগৃতির বিষয়ে আলোচনা করতে কয়েকটা বিষয় উত্থাপন করেছেন। মানববোধ, যুক্তিবাদ, ঐতিহ্য-উদ্ধার, নবধর্মান্দোলন, দুই ধারার দ্বন্দ্ব, স্বদেশচেতনা, বাংলার নবজাগৃতির সীমার কথা আলোচনা করেছেন। 

‘আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ের নাম ‘উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ : নবজাগৃতির প্রস্তুতি’। এই নিবন্ধে তিনি সাহিত্যের নবপর্যায়ের কথা আলোচনা করেছেন। উনিশ শতকে গদ্যসাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধের পূর্বে কোনো সৃজনশীল রচনার আবির্ভাব হয়নি। বুদ্ধি-জ্ঞান-চিন্তার রাজ্যের বাহন হিসেবে গদ্য সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছে। এরসঙ্গে ধীরে ধীরে রসসৃষ্টির ক্ষমতাও যুক্ত হয়৷ 

‘গদ্যসাহিত্য’ প্রবন্ধে গদ্যের প্রস্তুতি পর্ব ও বিকাশ সম্পর্কে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। বাংলা গদ্যের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে বিদেশি লেখকদের নানা মতভেদ রয়েছে। তবে ক্ষেত্রগুপ্ত নিজেও উইলিয়াম কেরী, মার্শম্যান, ইংরেজ মিশনারিদের অবদান স্বীকার করেছেন। তিনি বাংলা গদ্যের আদিরূপের মধ্যে চারটি রীতি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন৷ সাহেবি রীতি, আদালতি রীতি, সাধুরীতি ও কথ্যরীতি এখানে স্থান পেয়েছে। প্রাক-আধুনিক বাংলা গদ্য-তে মিশনারি ভাষায় বাংলা গদ্য, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ও এর পণ্ডিতরা, সাময়িক পত্র প্রভৃতির মাধ্যমে গদ্য-সাহিত্যের প্রসার ঘটেছে। ক্ষেত্রগুপ্তের অন্যতম আরেকটি গবেষণাগ্রন্থ ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এই গ্রন্থে শরৎচন্দ্রের বিভিন্ন উপন্যাসের বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। সমকালেরু সমাজজীবনের প্রেক্ষিতে শরতের উপন্যাসকে চিহ্নিত করেছেন। তার বাংলা উপন্যাসের ইতিহাস গ্রন্থে বাংলা উপন্যাসের বিকাশ ও পরিবর্তন নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এছাড়া সমালোচনা গ্রন্থে বাংলা সাহিত্যের সমালোচনার বিভিন্ন দিক, বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস : শিল্পরীতি গ্রন্থে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের শিল্পরীতি, মধুসূদনের কবি-আত্মা ও কাব্যশিল্প গ্রন্থে মধুসূদন দত্তের কবিতার আত্মা ও শিল্পরীতি, রবীন্দ্র-গল্প : অন্য রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পের ভিন্ন দিক, সংযোগের সন্ধান : লোকসংস্কৃতি-তে বাংলা লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা করেছেন।

ক্ষেত্রগুপ্তের সমালোচনা সাহিত্যের প্রধান অবদান হলো বাংলা সাহিত্যচর্চাকে একটি দৃঢ় তাত্ত্বিক ও গবেষণাধর্মী ভিত্তি দেওয়া। তিনি রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগের সমালোচনা সাহিত্যকে আবেগনির্ভর প্রশংসা-নিন্দার বাইরে এনে জ্ঞান, যুক্তি ও দর্শনের স্তরে উন্নীত করেছিলেন। ফলে তাকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যসমালোচনার অন্যতম পথপ্রদর্শক বলা হয়।