মোহাম্মদ রফিকুল আলম। বয়স ৫০। গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জে। ঢাকার রমনা এলাকায় একটি বহুতল ভবনে নিরাপত্তারক্ষীর চাকরি করেন। চার সদস্যের পরিবারের এই কর্তা ব্যক্তি বেতন পান মাত্র ১২ হাজার টাকা। পরিবারের অন্য তিনজন সদস্য গ্রামের বাড়িতে থাকলেও ঢাকায় তিনি সাবলেট থাকেন। মাস শেষে যে টাকা বেতন পান তা নিজের জন্য খরচ করেন এবং বাকি টাকা পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।
এত কম টাকায় চাকরি করেন কেন এমন প্রশ্ন শুনে রফিকুল আলম বললেন, কি করব! কিছু তো একটা করতে হবে! কাজ পাই না তাই এটি করি।
কেমন চলছে জীবন এই বেতনের টাকা দিয়ে? উত্তরে বলেন, ভালো না। কোনো রকম বেঁচে আছি। আমরা ভালো নেই। যে টাকা পাই কোনো রকম খেতেই শেষ হয়। একটু ভালো পোশাক পরার ইচ্ছা তৈরি হলেও তা পারিনা। ভালো খেতে পারি না। সন্তানকে ভালো কিছু কিনে দিতে পারি না।
ঢাকার শ্রমজীবী মানুষের জীবন কিছুটা এমনই। কথা হয় অপর এক বহুতল ভবনের নিরাপত্তা কর্মী আনোয়ার হোসেনের সাথে। ৬০ বছর বয়সী এই নিরাপত্তা কর্মীর পরিবারের সদস্য পাঁচজন। বেতন পান মাত্র সাড়ে ১১ হাজার টাকা। পরিবারের সদস্য নিয়ে ঢাকায় থাকেন। এত কম বেতনে পরিবার নিয়ে কিভাবে ঢাকায় থাকেন? তিনি বললেন, আগে কিছু টাকা জমিয়ে রেখেছিলাম সেগুলো এখন একটা কাজে লাগাই। যেখান থেকে কিছু টাকা আসে। সেই টাকা এবং আমার বেতনের টাকা, দুটো মিলে সংসার চালাই। কোনো রকম বেঁচে থাকি।
ছেলে মেয়েকে পড়ালেখা করাচ্ছেন? তিনি বলেন, যেখানে সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকাটাই মুশকিল সেখানে কিভাবে পড়ালেখা করাবো। আনোয়ার হোসেন আরো বলেন, ছেলেকে কাজের জন্যে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।
নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষের জীবন এবং তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সম্পর্কে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন দৈনিক খবর সংযোগকে বলেন, বাংলাদেশের শ্রম শক্তির জরিপ অনুযায়ী, শ্রমশক্তির সংখ্যা সাত কোটি ৩৬ লাখ। এর মধ্যে ৮৫ শতাংশ কাজ করে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। যার সংখ্যা ৬ কোটি ২৫ লাখ। আর প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে এক কোটি ১১ লাখের মতো।
রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে যারা কাজ করেন তাদের না আছে কর্ম ঘণ্টা, না আছে ন্যায্য মজুরি। আর না আছে চাকরির নিশ্চয়তা। সেই সাথে নেই তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের কোন প্রতিশ্রুতিও। তাদের জীবনটা অনেকটা দিন মজুরের মতই। সরকার বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয়ের যে হিসাব দেয় দেশের কর্মক্ষম মানুষের অন্তত সেই আয়টা হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু তা হচ্ছে না। আমাদের মাথাপিছু গড় আয়ের অর্ধেকও আমাদের শ্রমিকরা আয় করতে পারছে না।
তিনি আরো বলেন, শ্রমিকদের মজুরির ৬০ শতাংশ ব্যয় হয় তাদের খাবার কেনায়। এটা করতে গিয়ে তাদের অন্যান্য খাতের যে ব্যয় তা তারা বহন করতে পারেন না। শ্রমিকরা অপুষ্টিতে ভুগছেন এবং তারা অপুষ্ট সন্তানও জন্মদান করছেন। স্বল্প মজুরি শুধুমাত্র বর্তমান শ্রমিকদের জীবনকে দুঃসহ করেই তুলছে না। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও একটা অপুষ্ট প্রজন্ম তৈয়ার করছে।