গত কয়েক দিন ধরেই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক ভূমিকম্পে সাধারণ মানুষের মধ্যে বাড়ছে উদ্বেগ। ভোর, সকাল কিংবা রাতে- যে কোনো সময়েই অনুভূত হচ্ছে ক্ষুদ্র থেকে মাঝারি মাত্রার কম্পন। ফলে বহু মানুষের মনে প্রশ্ন- এত কম সময়ে ধারাবাহিক ভূমিকম্প কি স্বাভাবিক, নাকি বড় কোনো ভূমিকম্পের আগাম সংকেত?
এদিকে ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র জানিয়েছে, দেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ছোট ছোট কম্পন হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তবে সাম্প্রতিক ধারাবাহিকতার বিষয়টি নজরে রেখেই বাড়তি পর্যবেক্ষণ চালানো হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভূমিকম্পের ঝুঁকি মানচিত্রের ‘নিম্ন ঝুঁকিপ্রবণ’ বা জোন-৩-এর আওতাভুক্ত।
শুক্রবার (২১ নভেম্বর) নরসিংদী ছিল ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল, যা দেশের অভ্যন্তরে সক্রিয় ফল্ট লাইনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে, দেশের ভূমিকম্প ঝুঁকি মানচিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্লেট বাউন্ডারি ও সক্রিয় ফল্ট লাইন থেকে দূরে থাকা জেলাগুলো তুলনামূলকভাবে কম ঝুঁকিতে রয়েছে।
ভূমিকম্পের ঝুঁকি বিবেচনায় আবহাওয়া অধিদপ্তরের মানচিত্র অনুযায়ী বাংলাদেশকে মূলত তিনটি জোনে ভাগ করা হয়েছে: জোন-১ (উচ্চঝুঁকি), জোন-২ (মাঝারি ঝুঁকি) এবং জোন-৩ (নিম্ন ঝুঁকি)।
সাম্প্রতিক গবেষণা এবং ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ভূপ্রাকৃতিক অবস্থানের কারণে সবচেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্টের অংশ হিসেবে রাজউক পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীতে ২১ লাখ ৪৫ হাজার ভবন রয়েছে। ঢাকার নিকটবর্তী মধুপুর ফল্টে (টাঙ্গাইল) ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানলে ঢাকা শহরের কয়েক লাখ ভবন ধসে পড়তে পারে। এর অন্যতম কারণ– অধিকাংশ ভবন তৈরির ক্ষেত্রে জাতীয় ভবন নির্মাণ কোড অনুসরণ করা হয়নি। বেশিরভাগ ভবন নির্মাণে সরকারি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেই। ৯৫ ভাগ ভবন নির্মাণ করা হয়েছে অনুমোদিত নকশার বাইরে।
জানা গেছে, চলতি বছর প্রায় সাড়ে ৩ হাজার অবৈধ ভবন চিহ্নিত করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এসব ভবনের বিরুদ্ধে অভিযানও পরিচালনা করছে সংস্থাটি। তাছাড়া কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই নগরীর বসিলা, ঢাকা উদ্যান ও কেরানীগঞ্জসহ আশপাশের এলাকায় শত শত ভবন গড়ে উঠেছে।
রাজধানীর মাস্টারপ্ল্যান ড্যাপের তথ্যমতে, ২০০৬ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৯৫ হাজার স্থাপনা গড়ে ওঠে। ওই সময় রাজউক থেকে মাত্র ৪ হাজার ১৪৭টি ভবন নির্মাণের অনুমোদন নেওয়া হয়। সে হিসাবে অনুমোদন ছাড়াই ৯৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে আগে থেকেই সতর্ক করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
যে জেলাগুলো কম ঝুঁকিপূর্ণ
খুলনা বিভাগ: খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, মাগুরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর।
বরিশাল বিভাগ: বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর, বরগুনা ও ঝালকাঠি।
রাজশাহী বিভাগের পশ্চিমাংশ: (কিছু অংশ জোন-২-এর হলেও পশ্চিমাংশ অপেক্ষাকৃত নিরাপদ)।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অঞ্চলগুলো মূল টেকটোনিক প্লেট বাউন্ডারি (যেমন: ডাউকি ফল্ট, মধুপুর ফল্ট বা মিয়ানমার ফল্ট লাইন) থেকে অপেক্ষাকৃত দূরে থাকায় সরাসরি বড় ধরনের কম্পন সৃষ্টির উৎস হিসেবে বিবেচিত হয় না।
উচ্চ এবং মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা
উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ (জোন-১): সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, এবং চট্টগ্রাম ও পার্বত্য এলাকার কিছু অংশ (রাঙামাটি, বান্দরবান)।
মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ (জোন-২): ঢাকা, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, নোয়াখালী, বগুড়া এবং রাজশাহী বিভাগের অধিকাংশ এলাকা।
কী বলছেন ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টেকটোনিক প্লেটের সক্রিয়তা বেড়ে গেলে কয়েক দিনের ব্যবধানে একাধিক ছোট কম্পন হওয়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। এই ক্ষুদ্র কম্পনগুলোতে শক্তি ধীরে ধীরে নিঃসরণ হয়, যা কখনও কখনও বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমিয়েও দেয়।
একজন জ্যেষ্ঠ ভূতাত্ত্বিক জানান, প্লেটের ভেতরে চাপ জমে থাকলে মাঝে মাঝে ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়। এগুলো প্রকৃতির স্বাভাবিক ‘রিলিজ মেকানিজম’। এতে আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই, তবে সচেতন থাকতে হবে।
আরেক বিশেষজ্ঞের মতে, ভূকম্পন বাড়ার আরেকটি কারণ হতে পারে এলাকার মাটির গঠন এবং গভীর ফল্ট লাইনের সাম্প্রতিক গতিশীলতা। কিছু ফোল্ট জোন দীর্ঘদিন নীরব থাকার পর হঠাৎ সক্রিয় হয়ে ওঠে। তখন ছোট কম্পন ঘন ঘন অনুভূত হয়।
আফটারশক নাকি বড় কিছুর ইঙ্গিত
জনগণের বড় প্রশ্ন- এতবার কম্পন কি বড় কোনো ভূমিকম্পের পূর্বাভাস?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোট কম্পন মানেই বড় ভূমিকম্প আসছে- এ ধারণা ভুল। পৃথিবীর বেশিরভাগ সক্রিয় অঞ্চলে প্রতিদিনই কয়েকশো ছোট কম্পন হয়, কিন্তু এর খুব অল্পই বড় ভূমিকম্পে রূপ নেয়।
তবে তারা এটিও সতর্ক করে বলছেন- যে কোনো ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে প্রস্তুতি বাড়ানোই সবচেয়ে জরুরি। কারণ বড় কম্পন কখন ঘটবে, সেটা আজও নিশ্চিতভাবে পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নয়।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূমিকম্প কখন ঘটবে বা কোনটা ছোট কম্পন থেকে বড় বিপর্যয়ে রূপ নেবে- এটা পৃথিবীর কোনো দেশই নির্ভুলভাবে বলতে পারে না। তাই আতঙ্কের বদলে প্রস্তুত থাকাই সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরক্ষা।
তাদের মতে, প্রতিটি পরিবারকে অন্তত একটি জরুরি ব্যাগ প্রস্তুত রাখতে হবে- যেখানে থাকবে প্রয়োজনীয় ওষুধ, টর্চলাইট, পানি, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র এবং জরুরি যোগাযোগ নম্বর। ঘরের ভারী আলমারি, বুকশেলফ বা ঝুলন্ত জিনিসপত্র ভালোভাবে বেঁধে রাখা উচিত, যাতে কম্পনের সময় সেগুলো পড়ে গিয়ে বড় ক্ষতি করতে না পারে।
এছাড়া ড্রপ, কভার, হোল্ড অন পদ্ধতি অনুশীলন করাকে বাধ্যতামূলক হিসেবে বিবেচনা করার কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা আরও সতর্ক করেছেন- ভয় ছড়ানো গুজব ও সামাজিকমাধ্যমের ভ্রান্ত তথ্য পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে; তাই শুধুমাত্র সরকারি বা স্বীকৃত উৎসের তথ্যই অনুসরণ করতে হবে।