মাত্র ১৬ বছরের কিশোর মো. রাব্বী। তার এই বয়সী অন্যান্য কিশোররা বই-খাতা নিয়ে যাচ্ছে স্কুলে। অথচ কিশোর রাব্বীর একদিনের জন্যও যাওয়া হয়নি স্কুলে। সে রোজ নিয়ম করে যাচ্ছে নদীতে মাছ শিকারে। গত ৬ বছর ধরে মেঘনার উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে অন্যান্য জেলেদের সঙ্গে মাছ শিকার করছে রাব্বী। তার মতো ভোলার লালমোহন উপজেলার জেলেপল্লীর এমন অসংখ্য শিশু-কিশোর পড়ালেখা না করে নদীতে মাছ শিকার করছে।
উপজেলার ধলীগৌরনগর ইউনিয়নের বাতিরখাল মৎস্যঘাট এলাকার বাসিন্দা কিশোর রাব্বী।
রাব্বী জানায়, আমাদের অসচ্ছল পরিবার। পরিবারের পক্ষে পড়ালেখার খরচ জোগানোর সাধ্য নেই। যার জন্য গত ৬ বছর ধরে স্থানীয় জেলেদের সঙ্গে নদীতে মাছ ধরতে যাচ্ছি। যেদিন নদীতে মাছ ধরতে নামি সেদিন গড়ে ৩০০ টাকার মতো পাই। এই টাকা থেকে কিছু নিজেও খরচ করি, পরিবারকেও দেই।
বাতিরখাল মৎস্যঘাট এলাকার ১০ বছর বয়সী শিশু মো. রিপন। তার জীবনও দোলে নদীর ঢেউয়ে। শিশু রিপনের এই বয়সে থাকার কথা স্কুলে। অথচ সেও মেঘনার উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে নদীতে মাছ শিকার করে। তার পরিবারে মা-বাবা, এক ভাই-এক বোন আছে। বাবা চট্টগ্রামে কাজ করেন বালুর জাহাজে।
শিশু রিপন জানায়, স্বজনদের সঙ্গে প্রথমে শখ করে নদীতে যাওয়া শুরু করি। সেই শখই এখন পেশা। প্রথম প্রথম নদীর উত্তাল ঢেউ দেখে ভয় হতো। তবে এখন সেই ভয় কেটে গেছে। এখন স্থানীয় অন্যান্য জেলেদের সঙ্গে নিয়মিত মাছ শিকারে যাই। যেদিন মাছ শিকারে যাই সেদিন কখনও ২০০, কখনও ৫০০ টাকা পাই। আবার কখনও খালি হাতেই ফিরতে হয়। যখন নদীতে গিয়ে মাছ ধরে টাকা পাই, তখন ঐ টাকা মায়ের হাতে তুলে দেই।
ঐ মৎস্যঘাটের ১৪ বছর বয়সী আরেক শিশু মো. আল-আমিন। বিদ্যালয়ের বারান্দায় তার পা পড়েছে ঠিকই। তবে তা দীর্ঘাস্থায়ী হয়নি। কোনো রকমে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হয়েছিল ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে। তখন থেকে মাঝে মধ্যে স্বজনদের সঙ্গে নদীতে যাওয়া শুরু হয় শিশু আল-আমিনের। একপর্যায়ে নদীতে মাছ শিকার করা তারও পেশা হয়ে যায়। মাছ শিকার পেশা হওয়ায় শিশু আল-আমিন ছেড়ে দিয়েছে পড়ালেখা। এখন তার রোজ যুদ্ধ দক্ষ জেলে হওয়ার।
জেলেপল্লীর শিশুদের এমন শিক্ষা বিমুখতার বিষয়ে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি এনজিও সংস্থা ‘দ্বীপ উন্নয়ন সোসাইটির’ নির্বাহী পরিচালক মো. ইউনূছ বলেন, পরিবারের দরিদ্রতা, অসচেতনতা এবং স্কুল দূরবর্তী স্থানে হওয়াসহ আরো বেশকিছু কারণে জেলেদের অধিকাংশ সন্তানরা তেমন পড়ালেখা করছে না। যার কারণে ঐসব শিশুরা খুব কম বয়সেই তাদের বাপ-দাদার পেশায় জড়িয়ে যাচ্ছে। তবে এসব শিশু এবং তাদের পরিবারের মাঝে সরকারিভাবে সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার পাশাপাশি আর্থিক বরাদ্দ প্রদান করা হলে জেলেপল্লীর শিশুরাও শিক্ষায় আগ্রহী হয়ে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠবে।
লালমোহন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তৌহিদুল ইসলাম দৈনিক খবর সংযোগকে বলেন, জেলেপল্লীর যেসব শিশুরা বিদ্যালয় বিমুখ বা ঝরে পড়ছে তাদেরকে শিক্ষার আওতায় আনতে আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবো। আমরা চাই প্রতিটি শিশুই সুশিক্ষায় শিক্ষিত হোক। এছাড়া জেলেদের জন্য সরকারিভাবে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা চলমান রয়েছে। ভবিষ্যতে যদি সরকারিভাবে জেলেদের জন্য আরও বরাদ্দ আসে আমরা তা জেলেদের যথা সময়ে পৌঁছে দেবো।