বিএনপির নতুন নেতৃত্বে তৃণমূল হতাশ, ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত!

নব্বইয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বের কাতারে অন্যতম ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তিনি এখন অসুস্থ অবস্থায় গৃহবন্দী। তার দল এখনো রাজপথে। তবে বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল ক্ষমতার বাইরে আছে প্রায় দেড় যুগ। এর মধ্যে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে তিনটি জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেছে, যার ২টি নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি।

বাকি একটি নির্বাচনে অংশ নিলেও তেমন প্রতিদ্বন্দিতা গড়ে তুলতে পারেনি। দশম ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিয়ে প্রতিরোধের ঘোষণা দিলেও মূলত তেমন কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি দলটি। ব্যাপক জনসমর্থন নিয়েও ক্ষমতার বাইরে থাকায় বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে সর্বত্র প্রশ্ন উঠেছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জন্য অপেক্ষা আর কত দিন - সেই প্রশ্ন এখন বিএনপির একেবারে ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যেও রয়েছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর প্রশ্নটি আরও জোরালো হয়েছে।

মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় এক সামরিক অভ্যুত্থানে তাকে হত্যা করা হয়। এরপর বিএনপির দায়িত্ব নেন বেগম খালেদা জিয়া, যিনি প্রথমবারের মতো ১৯৯১ সালের ২০ মার্চ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃতে বিএনপি তিনবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়।

১৯৯৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির চতুর্থ কাউন্সিলে খালেদা জিয়া চেয়ারপারসন ও আবদুস সালাম তালুকদার মহাসচিব নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালে ৫ম জাতীয় কাউন্সিলে খালেদা জিয়া চেয়ারপারসন ও খন্দকার দেলোয়ার হোসেন মহাসচিব এবং তারেক রহমান সংগঠনের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এর আগে ২০০২ সালে তারেক রহমান দলের স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন।  

২০১৬ সালে ৬ষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে খালেদা জিয়া চেয়ারপারসন ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মহাসচিব নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পর তারেক রহমান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। 

সরকারবিরোধী এক দফার আন্দোলনে ব্যর্থতার পর রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিএনপির নেতাকর্মীদের বড় একটি অংশের মধ্যে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বের সক্ষমতা ও দেশ-বিদেশে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। তারেক রহমানও দেশে নেই। তিনি যুক্তরাজ্য থেকে দল পরিচালনা করছেন। তাঁর নির্দেশনামতোই কমিটি গঠন, কমিটিতে রদবদল, আন্দোলন-কর্মসূচি সংঘটিত হয়। যা নিয়ে খোদ দলের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। 

বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়ার পর তারেক রহমান বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো অনেকটাই বদলে ফেলেছেন। তিনি গত কয়েক বছরে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দলসহ অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতৃত্বে পরিবর্তন আনেন। সব মহানগরে পুরনোদের বাদ দিয়ে নতুন কমিটি করেন; যা অনেক ক্ষেত্রে সঠিক ছিল না বলে দলে আলোচনা উঠেছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, নেতৃত্বের এই পরিবর্তনগুলো বিগত আন্দোলনে কতটা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পেরেছে। 

বিভাগীয় শহরে দুর্বল নেতৃত্ব: বিএনপির নেতাকর্মীদের অনেকে আক্ষেপ করে জানান, একসময় মির্জা আব্বাস ও সাদেক হোসেন খোকার মতো ব্যক্তিরা ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতৃত্ব দেন। এখন তারেক রহমান বিএনপির নেতৃত্বকে দুর্বল করে ফেলেছেন। বর্তমানে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল আলম নীরব, সদস্য সচিব আমিনুল হক ও  ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহবায়ক রফিকুল আলম মজনু, সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিন। এদের ঢাকা মহানগরে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিগত দিনে এরা আন্দোলন সংগ্রামে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। এদের মধ্যে আমিনুল হক ২০১৬ সালে বিএনপির ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক হন। এর আগে তিনি রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। 

একইভাবে চট্টগ্রামে বিএনপির দায়িত্ব পালন করেছেন আবদুল্লাহ আল নোমান ও মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, ডা. শাহাদাৎ হোসেন। এখন চট্টগ্রাম মহানগরের আহবায়ক এরশাদুল্লাহ ও সদস্য সচিব নাজিমুর রহমান। এদের মধ্যে কেউই আবদুল্লাহ আল নোমান, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন ও ডা. শাহাদাৎ হোসেনের মতো জনপ্রিয় ও ব্যক্তি ইমেজ নাই। আগে রাজশাহীতে মিজানুর রহমান (মিনু), সাবেক মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ছিলেন। বর্তমানে রাজশাহী মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ আলী ও সদস্য সচিব মামুনুর রশিদ।

খুলনায় আগে নেতৃত্বে ছিলেন নজরুল ইসলাম (মঞ্জু)। বর্তমান সেখানে কেএম হুমায়ূন কবীর আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব হিসেবে মোল্লা ফরিদ আহমেদ কমিটি আগলে রয়েছেন। সিলেটে আরিফুল হক চৌধুরীর মতো জনপ্রিয় নেতৃত্বের জায়গায় এখন মহানগর বিএনপির সভাপতি নাসিম হোসাইন ও সাধারণ সম্পাদক এমদাদ হোসেন চৌধুরী দায়িত্ব পালন করছেন। বরিশালে মজিবর রহমান সরোয়ারের মতো নেতারা ছিলেন বিএনপির কাণ্ডারি। এখন নতুন কমিটিতে আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মনিরুজ্জামান খান ফারুক এবং সদস্য সচিব মো. জিয়াউদ্দিন সিকদার জিয়া। 

এসব জায়গায় এখন যাঁরা নেতৃত্বে রয়েছেনস তাঁদের সাংগঠনিক দক্ষতা এবং গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দলের ভেতরে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন আছে। শুধু তারেক রহমান বা বিশেষ কারও পছন্দে অনেকে নেতৃত্ব পেয়েছেন, যাঁদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সম্পর্কে প্রশ্ন রয়েছে। ফলে ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতৃত্বের যোগ্যতা ক্রমেই নিচের দিকে নামছে বলে সমালোচনা রয়েছে।

এদিকে দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসংগঠন ও রাজপথের ভ্যানগার্ড হিসেবে পরিচিত জাতীয়তাবাদী যুবদলের আব্দুল মোনায়েম মুন্নাকে সভাপতি এবং নুরুল ইসলাম নয়নকে সাধারণ সম্পাদক করে সুপার সিক্স কমিটি ঘোষণা করেছে বিএনপি। কমিটি বিলুপ্তির ২৫ দিন পর মঙ্গলবার (৯ জুলাই) ঘোষিত নতুন কমিটি নিয়ে হতাশ, ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত হয়েছেন সংগঠনটির নেতাকর্মী।

রাজপথে ভূমিকা পালনকারী, ত্যাগী, নির্যাতিত আর যোগ্যদের বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত ও সিন্ডিকেটের নেতাদের দিয়েই কমিটি গঠন করেছেন দলটির হাইকমাণ্ড। এমনকি দলের নীতিনির্ধারক নেতাদের মতামতকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি এ কমিটি গঠনে। এতে দলের বিভিন্ন স্তরে ভুল বার্তা যাবে বলে মনে করেন নেতাকর্মীরা। যা একসময় দলের ভেতর সংকট তৈরি হতে পারে বলেও শঙ্কা ব্যক্ত করেন তারা।

ঢাকার বাইরের বিভিন্ন অঞ্চলের বিএনপির একাধিক নেতা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ২০১৩-১৪ সালে যে আন্দোলন হয়েছিল, ২০২৩ সালে সেটা তেমন হয়নি। সংগঠন কর্মীহীন ও দুর্বল হয়ে গেছে। মাঠের বাস্তবতা অনুযায়ী যে নেতৃত্ব আসা উচিত, তা নেই। দিনে দিনে নেতৃত্ব দুর্বল হচ্ছে, যে কারণে প্রতিরোধের আন্দোলন সফল হয়নি।

নেতাদের ভিন্নমত: অবশ্য আন্দোলনে বিএনপির নেতৃত্বের ব্যর্থতা বা কৌশলগত কোনো দুর্বলতা আছে বলে মনে করেন না দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, বিরোধী দলকে দমন-নিপীড়নের যত যন্ত্র আছে, সরকার সব কৌশল নির্বিচারে ব্যবহার করেছে। গত ১৫ বছরে আমাদের ছয় শতাধিক নেতাকর্মীকে গুম, প্রায় অর্ধাশতাধিক  নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। কারাগারে মৃত্যু হয়েছে ১৫ জনের। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, ১৫ বছর ধরে আমাদের আন্দোলন চলছে। আন্দোলনে অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। মাঝে নেতা-কর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। সেখান থেকে সারা দেশে দলকে পুনর্গঠন করেন তারেক রহমান। আশা করি, দল এর ফল পাবে। হয়তো আরও কিছুটা কষ্ট করতে হবে।