ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

প্রধান উপদেষ্টার কাছে রাজনৈতিক দলের যত প্রত্যাশা

আপডেট : ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৪৫ এএম

‘রাষ্ট্র সংস্কার এবং ছয় সংস্কার কমিশন গঠন’ ইস্যুতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে গতকাল সংলাপ করেছে রাজনৈতিক দলগুলো।

শনিবার (৫ অক্টোবর) রাজধানীর হেয়ার রোডে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় দুপুর আড়াইটায় বিএনপি, বিকেল ৩টায় জামায়াতে ইসলামী, সাড়ে ৩টায় গণতন্ত্র মঞ্চ এবং ৪টায় বাম গণতান্ত্রিক জোট, সাড়ে ৪টায় হেফাজতে ইসলাম, ৫টায় ইসলামী আন্দোলন, সাড়ে ৫টায় এবি (আমার বাংলাদেশ) পার্টি সংঙ্গে সংলাপ হয়।

সব মিলিয়ে ৫টি দল ও ৩টি জোটের সঙ্গে প্রথম দিনের আলোচনা হয়। প্রধান উপদেষ্টার এটি তৃতীয় দফা সংলাপ। সর্বশেষ গত ৩১ আগস্ট রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করেন তিনি।

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও তার জোটসঙ্গীদের এই সংলাপের বাইরে রাখা হয়েছে। জাতীয় পার্টিকে এখন পর্যন্ত আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তবে আগামী শনিবার আরও কয়েকটি দলকে সংলাপে ডাকা হতে পারে বলে জানা গেছে।

গত ১১ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রধানের নাম ঘোষণা করেন। পরে নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য সরকার ইতিমধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে পাঁচটি কমিশনও গঠন করেছে।  শিগগিরই সংবিধান সংস্কার কমিশনও চূড়ান্ত করা হবে।

রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে সরকার ও সংস্কার কমিশনকে সহযোগিতা করতে পারে, সে বিষয়ে আলোচনা ও মতামত চাওয়া হয় প্রথম দিনের বৈঠকে।

একই সাথে ৯ সেপ্টেম্বর থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজা, আইনশৃঙ্খলাসহ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে দলগুলোর সাথেও আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত এই সংলাপে বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে আলাদা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তবে এই বৈঠকে ডাক পায়নি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও তাদের শরিক ১৪ দলভুক্ত কোনও রাজনৈতিক দল।

সরকার গঠনের পরপর প্রধান উপদেষ্টার সাথে প্রথম দফায় রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে অনুষ্ঠিত বৈঠকে জাতীয় পার্টি আমন্ত্রণ পেলেও এবার তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

শনিবার রাতে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘সংলাপের বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে এবার আমাদের কিছু জানানো হয়নি। এখনও পর্যন্ত আমরা জানিও না আমাদের ডাকা হবে কি না!

এর আগের দফা সংলাপে জাতীয় পার্টিকে আমন্ত্রণ জানানোয় তখন তা নিয়ে নানা বিতর্কও তৈরি হয়েছিল।

সংলাপে কোন দলের কারা প্রতিনিধিত্ব করেন
বিএনপি: দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান ও সালাহউদ্দিন আহমেদ।

জামায়াতে ইসলামী: এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন, নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, আ ন ম শামসুল ইসলাম ও মুজিবুর রহমান এবং সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল হালিম।

গণতন্ত্র মঞ্চ: ১২ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন মঞ্চের সমন্বয়ক নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। তাঁর সঙ্গে ছিলেন, জেএসডির আসম আবদুর রব, শহিদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, আকবর খান, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, আবুল হাসান রুবেল, ভাসানী অনুসারী পরিষদের শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, আবু ইউসুফ সেলিম, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ুম, ইমরান ইমন এবং নাগরিক ঐক্যের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার।

বাম গণতান্ত্রিক জোট: প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন জোটের সমন্বয়ক বাসদ (মার্কস বাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা। প্রতিনিধি দলে আরও ছিলেন সিপিবির শাহ আলম, রুহিন হোসেন প্রিন্স, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের ইকবাল কবির, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির মোশরেফা মিশু, বাসদের বজলুর রশীদ এবং সমাজতান্ত্রিক পার্টির আবদুল আলী।

ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ: ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন দলটির আমির চরমোনাই পীর সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম। তার সঙ্গে ছিলেন সিনিয়র নায়েবে আমির ফয়জুল করীম, মহাসচিব ইউনুস আহমেদ, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান ও যুগ্ম মহাসচিব আশরাফুল আলম।

হেফাজতে ইসলাম: ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন হেফাজতে ইসলামীর মহাসচিব মাওলানা সাজেদুর রহমান। প্রতিনিধি দলে ছিলেন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামীর আমির মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, খেলাফত মজলিশের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, নেজামে ইসলাম পার্টির নির্বাহী সভাপতি মাওলানা আশরাফুল হক, মহাসচিব মাওলানা মোমিনুল ইসলাম।

এবি পার্টি: পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন দলের আহ্বায়ক এএফএম সোলায়মান চৌধুরী। প্রতিনিধি দলে ছিলেন, সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু, যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুল ওহাব মিনার, সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, সহকারী সদস্য সচিব নাসরিন সুলতানা মিলি।

একটানা ১৫ বছরের বেশি সময় দেশ শাসনের পর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে নির্বাচন চেয়ে সরব হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু সেই সারিতে সামনে থাকা দেশের অন্য দুই প্রধান দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর চাওয়ায় যেন কিছুটা ভিন্নতা লক্ষ করা যাচ্ছে। 

বিএনপি দ্রুততম সময়ে নির্বাচন চাইলেও তাদের সঙ্গে সুর মেলাচ্ছে না জামায়াত। বিএনপি দ্রুত কমিশন গঠন করে নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করলেও, নির্বাচনের চেয়ে সংস্কারে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে জামায়াত।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপকে ঘিরে দল দুটির বিপরীতমুখী অবস্থানের চিত্র ফুটে উঠেছে।

বিএনপি চায় নির্বাচনের রোডম্যাপ
প্রধান উপদেষ্টার সাথে এই বৈঠকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা এবং সে জন্য একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করাসহ আরও বেশ কিছু দাবি তুলে ধরে বিএনপি। এক ঘণ্টাব্যাপী এই সংলাপে বিএনপির মহাসচিব ছাড়াও দলটির স্থায়ী কমিটির আরও পাঁচজন সদস্য উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক শেষে বিএনপি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন স্থগিত করে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে অনতিবিলম্বে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। এজন্য আমরা একটা রোডম্যাপ দিতে বলেছি। এই আলোচনায় নির্বাচন সংস্কার কমিটিতে কোনও বিতর্কিত ব্যক্তিকে না রাখা, জাতীয় পরিচয়পত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল, দেশের সব ইউনিয়নের নির্বাচিত পরিষদ বিলুপ্ত করার দাবিও জানায় দলটি।

বিএনপি মহাসচিব জানান, শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়া দশম সংসদ থেকে শুরু করে সব জাতীয় নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করা সিইসি ও কমিশনারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা। একই সাথে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে রায় দেওয়ায় সাবেক বিচারপতি খায়রুল হককেও বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর দাবি জানানো হয়েছে। দেশের সাম্প্রতিক কিছু অসঙ্গতি নিয়েও এই সংলাপে আলোচনা হয়েছে বলে জানান বিএনপি মহাসচিব।

৯ অক্টোবর রূপরেখা জানাবে জামায়াত
বিএনপির পরই প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তাদের নেতৃত্ব দেন দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান। পরে তিনি সাংবাদিকদের জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দুটি রোডম্যাপের পাশাপাশি কিছু মৌলিক বিষয় সংস্কারের দাবি জানিয়েছি। আগামী ৯ অক্টোবর জাতির সামনে কী কী সংস্কার প্রয়োজন, তা তুলে ধরবো আমরা।

জামায়াতের আমির বলেন, আমরা আমাদের চিন্তা জাতির সামনে তুলে ধরব কী কী সংস্কার এই মুহূর্তে প্রয়োজন, কী কী সংস্কার পরবর্তী পর্যায়ে আমাদের লাগবে।

জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আমরা শুরু থেকে বলে আসছিলাম সংস্কারের জন্য সরকারকে যৌক্তিক সময় দিতে চাই। সেই যৌক্তিক সময়টা কী হবে? এটা নিয়ে অচিরেই আমরা কাজ করব।

দেশের চলমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিষয়ে জামায়াত নেতা বলেন, দেশের বর্তমান অবস্থায় জনগণ আর সরকার একসাথে কীভাবে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরো উন্নতি করতে পারে এবং সকল ধরনের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে সেই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা আশা করছি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিরপেক্ষ দৃষ্টি থেকে দেশকে একটা ভাল জায়গায় নিয়ে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে সক্ষম হবেন। এক্ষেত্রে এটাও আমরা আশা করছি যে এই সময়টা নাতিদীর্ঘ হবে। এই বৈঠকে দুর্গাপূজায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখার জন্য করণীয় কী হবে, এ বিষয়েও আলোচনা হয়েছে বলে দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

অন্য দলগুলো যেসব প্রস্তাব দিয়েছে
রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে অনুষ্ঠিত এই সংলাপে গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দেওয়া সংস্কারের বিষয়গুলো তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, আমরা একটা সরকার বদলানোর আন্দোলন করছি না, নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করছি না। সামগ্রিকভাবে আন্দোলন করছি যাতে নির্বাচন ব্যবস্থা ও সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায়। আবার যাতে ফ্যাসিবাদ ফিরে না আসে।

এই সংলাপে অংশ নিয়ে ইসলামী আন্দোলনের নেতারা বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত যে সব জাতীয় অনুষ্ঠিত হয়েছে তার বেশির ভাগই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম সংলাপ শেষে গণমাধ্যমকে বলেন, স্বৈরাচার, খুনি, ফ্যাসিস্টরা যেন নির্বাচন করার সুযোগ না পায়, সেটা নিয়ে আমরা উপদেষ্টাদের বলেছি। দলের পক্ষ থেকে নির্বাচন সংস্কারের পাশাপাশি ভোটের আনুপাতিক হারে সংসদে প্রতিনিধিত্ব চালুর দাবি জানায় ইসলামী আন্দোলন।

বাম গণতান্ত্রিক জোটের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, সংস্কার কমিশনের মধ্যে প্রধান হল নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার। সেটা আজ থেকে, রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে কথা বলে পূর্ণাঙ্গ সংস্কার করে নির্বাচন কবে হবে, সেটার রোড ম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। একই সাথে প্রশ্নবিদ্ধ কোনও কাজ না করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পরামর্শ দেয় বাম গণতান্ত্রিক জোট।

প্রধান উপদেষ্টার সাথে অনুষ্ঠিত সংলাপে গণঅধিকার পরিষদ অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের পরিকল্পনা ও রোডম্যাপ প্রকাশ, আওয়ামী লীগের বিচার, অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে উপদেষ্টা পরিষদের পরিসর বাড়ানোসহ ১২ দফা প্রস্তাব তুলে ধরে।

SM/FI
আরও পড়ুন