মৌমাছির কামড়ে জীবন ফিরে পেলেন এলি! 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সান জোসের এলি লোবেল, ৪৫ বছর বয়সী তিন সন্তানের জননী এলি একজন নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ। একসময় নিজেই স্বেচ্ছামৃত্যুর ইচ্ছা পোষণ করেন। কারণ লাইম ডিজিজে আক্রান্ত হয়ে টানা ১৫ বছর হুইলচেয়ারে বন্দি জীবন, শারীরিক যন্ত্রণা, স্মৃতিভ্রংশ আর মানসিক অবসাদ- সব কিছুই তাকে বিশাদগ্রস্ত করে তুলেছিল।  

এলির বয়স যখন ২৭ বছর তখন তাকে টিক পোকা কামড়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে ফুসকুড়ি বাদে তেমন কোনো সমস্যা দেখা না দিলেও কিছুদিন পর শরীরে দেখা দেয় নানান সমস্যা। তিন মাস ধরে ফ্লুর মতো লক্ষণ এবং সারা শরীরে ভয়াবহ ব্যথা অনুভূত হচ্ছিল। তার শরীরে বোরেলিয়া বার্গডরফেরি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত হয়। তিনি আক্রান্ত হন ‘লাইম ডিজিজে’।  

সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, চিকিৎসকরা ধরতেই পারছিলেন না এলির রোগটা কি। একেক সময় তারা একেক রোগের নাম বলতেন। কখনো কোনো চিকিৎসক বলতেন মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস, কখনো আবার লুপাস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, ফাইব্রোমায়ালজিয়া। রোগে আক্রান্ত হওয়ার এক বছরেরও বেশি সময় পরেও তাদের কেউই বুঝতে পারেননি যে তিনি বোরেলিয়ায় আক্রান্ত। যখন বুঝতে পারলের ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ততদিনে এলি বিছানাশয্যা। হুইলচেয়ার তার একমাত্র ভরসা।

এলি নিজে থেকেই কোনো কিছুই করতে পারেন না। তার দেখাশোনার জন্য আছেন একজন কেয়ারগিভার। সন্তানরা ততদিনে বড় হয়ে গেছেন। যে যার মতো থাকেন। এলি এই হুইলচেয়ারে বন্দি জীবন থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে থাকেন। তিনি ভেবেই নিয়েছিলেন এভাবে হয়তো আর তিন থেকে চার মাস তিনি বেঁচে থাকতে পারবেন।

সময়টা ছিল ২০১১ সালের জুন মাস। স্বেচ্ছামৃত্যুর জন্য চলে যান ক্যালিফোর্নিয়ার এক গ্রামে। কিন্তু সেই গ্রামে তার মৃত্যু নয়, বরং জীবন নতুন করে শুরু হয় এলির। কীভাবে? বলছি। একদিন সকালে এলি তার কেয়ারগিভারের সঙ্গে বাইরে বেড়াতে বের হোন। রৌদ্রজ্জ্বল দিনটি মাত্র শুরু হয়েছে। হঠাৎ করেই কোথা থেকে একটি মৌমাছি এসে এলির কপালে হুল ফুটালো। এরপর ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি তাকে ঘিরে ধরে। কামড়াতে শুরু করে পুরো শরীরে।

এলির পালানোর সুযোগ ছিল না। কিন্তু কেয়ারগিভার তাকে সরাতে না পেরে নিজেই পালিয়ে বাঁচে মৌমাছির হাত থেকে। এলি শুধু মুখ ঢেকে বসে ছিল। আর এটিই ভাগ্য বলে ধরে নিয়েছিল। মরার জন্যই তো এখানে এসেছিলেন তিনি। এভাবেই হয়তো তার মৃত্যু আছে তাই ভেবে নিজেকে শান্তনা দিতে থাকলেন।

এলির ছিল মৌমাছির বিষে তীব্র অ্যালার্জি। দুই বছর বয়সে একবার একটি মৌমাছি তাকে কামড় দিয়েছিল। যা থেকে অ্যানাফিল্যাক্সিসে আক্রান্ত হন তিনি। অ্যানাফিল্যাক্সিসে আক্রান্ত হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, শরীর ফুলে যাওয়া, বমি বমি ভাব এবং শ্বাসনালী সংকুচিত হওয়ার মতো শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। যার ফলাফল হতে পারে মৃত্যু। তবে সে যাত্রায় বেঁচে যান এলি। তবে তার মধ্যে মৌমাছি ভীতি ঢুকে গিয়েছিল ছোট থেকেই।

এবার বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি এলি। কিছুক্ষণ পরই তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। কিছুক্ষণ পর এলির কেয়ারগিভার ফিরে আসেন। অজ্ঞান অবস্থায় তাকে খুঁজে পান। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন এলি হয়তো মারা গেছেন। তবুও হাসপাতালে নেওয়া হয় এলিকে।

হাসপাতালে নেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার শরীরে শুরু হয় তীব্র ব্যথা ও জ্বর। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এর সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হলো, ‘এরিশ হ্যারেক্স হাইমার’ প্রতিক্রিয়া। দেহের ভেতরে থাকা বিষাক্ত ব্যাকটেরিয়া মরার সময় তাদের শরীর থেকে বেরিয়ে আসা টক্সিনের কারণে এটা হয়।

এই ঘটনার তিনদিন পর এলি লক্ষ করলেন তার ব্যথা কমে গেছে; যে ঘোরের মধ্যে ছিলেন, সেটা কেটে গেছে। শরীরের ব্যথা অনেকটাই কমে গেছে। স্মৃতিশক্তি ফিরছে, হাঁটতে পারছেন। সুস্থ হয়ে এলি নিজেই শুরু করেন গবেষণা। খুঁজে পান ১৯৯৭ সালের একটি ছোট গবেষণা, যেখানে দেখা যায় মৌমাছির বিষে থাকে মেলিটিন নামে এক বিশেষ ধরনের পেপটাইড, যা ব্যাকটেরিয়ার কোষের ঝিল্লি গলিয়ে দেয়। মেলিটিন সরাসরি বোরেলিয়াকে নিষ্ক্রিয় করে।

এলি এরপর নিজের বাসায় শুরু করেন অ্যাপিথেরাপি বা নিয়মিত মৌমাছির হুল প্রয়োগ। প্রতিদিন ১০টি হুল, সপ্তাহে ৩ দিন। হাজার হাজার হুলের পর তিন বছর ধরে এলি হয়ে উঠলেন সম্পূর্ণ সুস্থ। এখনো তিনি মাঝেমধ্যে হুল প্রয়োগ করেন শুধু বাড়তি রোগ প্রতিরোধের জন্য। 

এলি বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সান জোসেতে বসবাস করছেন। গবেষণা করছেন মৌমাছির বিষ নিয়ে। লাইম রোগের জন্য মৌমাছির ভেনম নিয়ে গবেষণা করছেন। এলির বাড়িতে আছে মৌমাছির বিশাল খামার। যেখান থেকে নিরাপদ ও প্রাণনাশহীন পদ্ধতিতে মৌমাছির বিষ সংগ্রহ করা হয়। যা সোনার চেয়েও মূল্যবান। এই বিষ এখন পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে ইউনিভার্সিটি অব নিউ হ্যাভেনের গবেষণাগারে। সূত্র: বিবিসি