কৃষকের ঘরে আলু, তাই বাজারে দাম বাড়ানোর কোন সিন্ডিকেট নেই। ফলে উৎপাদনকারী কৃষক পরেছে এক মহাদুর্ভোগে। উৎপাদন খরচ তুলতে যেয়ে তাদের গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। যে দামে সে আলু বিক্রি করছে তাতে তার খরচের অর্ধেক দামও উঠছে না। বাজারে আলুর দাম কমার কারণে বাড়ছে রপ্তানি। চলতি অর্থবছরের গত ১৫ মার্চ পর্যন্ত (আট মাসে) ২৪ হাজার টন আলু রপ্তানি করা হয়েছে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)।
জানালেন সিরাজদিখান উজেলার কুসুমপুর মহল্লার আলু চাষী ইমরান আলি। তিনি জানান, গত বছর আলুতে একধরনের সঙ্কট নেমে এসেছিল। বাজারে আলুর দাম বাড়তে বাড়তে একশ টাকার ঘর স্পর্শ করে। সেই ভাবনা থেকে এবছর আলু চাষে সময় বাড়িয়ে দিই। এমনকি চাষের জন্য বেশ কয়েক কানি জমি নতুন করে আলুতে বিনিয়োগ করি। ফলন ভালো হয়েছে। কিন্তু বাজারে দাম নেই। ফলে অনেকটাই দুর্ভেগে পড়েছি আলু নিয়ে। সামনে ঈদ বাচ্চাদের নতুন জামা কাপড় কিনে দিতে হবে। কিন্তু বাজারে যে দামে আলু বিক্রি হচ্ছে তাতে লোকসান বাড়বে। তারপরেও ঈদ বলে কথা লোকসান হলেও বিক্রি করতে হবে? অন্তত ছেলেমেয়েদের মুখে হাসি ফোটানোর চাইতে লোকসানটি খুব বড় কিছু নয়। এদিকে সরকার দেশের অভ্যন্তরীন বাজারে আলুর দাম কম থাকায় আলু রপ্তানির দিকে হাঁটছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ১৫ মার্চ পর্যন্ত প্রায় ২৪ হাজার টন আলু রপ্তানি হয়েছে। এটি গত অর্থবছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। শুধু ফেব্রুয়ারিতেই প্রায় ১২ হাজার টন আলু রপ্তানি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের মোট রপ্তানির সমান।
দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক কৃষক প্রতি কেজি আলু গড়ে ১১ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। অথচ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয়েছে প্রায় ১৪ টাকা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রেকর্ড পরিমাণ জমিতে আলু চাষের কারণেই রপ্তানি বেড়েছে। চলতি অর্থবছরে ৫ লাখ ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি।
এ বছর নেপাল, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে প্রায় নয় হাজার টন আলু রপ্তানি হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইংয়ের পরিচালক হাফিজুর রহমান মিন্টু মুঠোফোনে জানালেন, দাম কম থাকায় এ বছর আলু রপ্তানি বেড়েছে। তিনি আরও জানান, গত অর্থবছরের মোট রপ্তানির তুলনায় চলতি অর্থবছরে রপ্তানি প্রায় ৮০ শতাংশ বেড়েছে। এ বছর রপ্তানিকারকরা স্থানীয় বাজার থেকে ১০ থেকে ২০ টাকা কেজি দরে আলু কিনতে পারছেন, যেখানে গত বছর কিনতে হয়েছিল ৩০ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে।
আরেক রপ্তানিকারক তাওহীদুল ইসলাম জানান, চলতি অর্থবছরে তিনি মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, নেপাল ও বাহরাইনে প্রায় আট হাজার ৪০০ টন আলু রপ্তানি করেছেন। এ বছর তিনি প্রতি কেজি আলু প্রায় ১০ টাকায় কিনতে পেরেছেন, যেখানে গত বছর কিনতে হয়েছিল ৩০ টাকায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক রপ্তানিকারক জানান, এ বছর কম দামের কারণে তিনি শ্রীলঙ্কায় এক হাজার ৩০০ টন আলু রপ্তানি করতে পেরেছেন। ব্যবসায়ীরা গ্রানোলা, ডায়মন্ড-৭ ও ম্যাজেস্টিকের মতো উচ্চ চাহিদা সম্পন্ন আলু রপ্তানি করছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রংপুর বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক মো. আফজাল হোসেন বলেন, উৎপাদন বেশি হওয়া সত্ত্বেও ভালো মানের আলুর পরিমাণ কম হওয়ায় রপ্তানিকারকরা সংকটে পড়ছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষকদের গ্রানোলা, সান্তানা ও কুমারীর মতো রপ্তানিমুখী জাত চাষের পরামর্শ দিয়েছে। ভবিষ্যতে এই জাতগুলোর চাষ বাড়ানো ও হিমাগার সংকট সমাধানের ওপর জোর দেন আফজাল হোসেন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মো. রফিকুল আমিন বলেন, রপ্তানি বাড়লে আলু চাষিরা স্বস্তি পাবেন।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় আলুর খুচরা দাম ২০ থেকে ৩০ টাকা থাকলেও কৃষক পর্যায়ে দাম বাড়তে শুরু করেছে। কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে মোট উৎপাদন ১ কোটি ২০ লাখ টন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মো. রফিকুল আমিন আরও বলেন, রপ্তানিকারকদের সঙ্গে কৃষকদের যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করা হচ্ছে।
তিনি মনে করেন, ভালো ফলন হওয়ায় গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে রপ্তানিকারকরা কম দামে আলু কিনতে পারছেন। তাই রপ্তানি বেড়েছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ আলু রপ্তানি শুরু করে, যদিও সে সময় খুব সামান্য রপ্তানি হয়েছিল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে গত নয় বছরে বাংলাদেশ গড়ে প্রায় ৫০ হাজার টন আলু রপ্তানি করেছে। তবে গত অর্থবছরে রপ্তানি আগের অর্থবছরের তুলনায় কমে যায়।