একদিকে ইউক্রেন যুদ্ধের উত্তাপ, অন্যদিকে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের টানাপোড়েন— এই দুই মেরুতেই ঘুরছে বর্তমান বিশ্বরাজনীতি। আর সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন একজন মানুষ— ভ্লাদিমির পুতিন। তার সাম্প্রতিক বক্তব্য ও হুঁশিয়ারি কেবল ইউরোপ নয়, গোটা আন্তর্জাতিক অঙ্গনকে নাড়া দিয়ে গেছে।
১. ইইউ নেতাদের উদ্দেশে পুতিনের ‘শান্ত হোন বার্তা
ভালদাই ডিসকাশন ক্লাবের মঞ্চে দাঁড়িয়ে পুতিন সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নেতাদের দিকে। ন্যাটো আক্রমণের আশঙ্কা যে নিছক ‘অকল্পনীয় ধারণা’— এ কথাটি তুলে ধরে তিনি ইউরোপীয় নেতাদের ‘অযোগ্য’ ও ‘অসৎ’ বলে আখ্যায়িত করেন।
তার পরামর্শ স্পষ্ট: জনগণকে ভয় দেখিয়ে বিভ্রান্ত করবেন না। বরং নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংকট সমাধান করুন। এখানেই ইঙ্গিত মেলে— ইউরোপ এখন ভেতরে ভেতরে অর্থনৈতিক ও সামাজিক টানাপোড়েনে ভুগছে। মুদ্রাস্ফীতি, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, রাজনৈতিক অস্থিরতা— সব মিলিয়ে পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলোতে চাপ বাড়ছে।
২. রাশিয়ার তেল ছাড়া বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের ভবিষ্যৎ
বিশ্বের তেল রপ্তানির প্রায় ১২ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। এই সরবরাহ বন্ধ হলে বৈশ্বিক অর্থনীতি কী ধরনের ধাক্কা খেতে পারে, তা নিয়ে উদ্বেগ তীব্র হচ্ছে। ইউরোপ প্রতিদিন কয়েক মিলিয়ন ব্যারেল তেলের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ভারত, চীন, তুরস্কের মতো দেশগুলো ডিসকাউন্ট মূল্যে রুশতেল কিনে নিজেদের অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সতর্কবার্তা: রাশিয়ার তেল পুরোপুরি বাদ দিলে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ১৫০ ডলার ছাড়াতে পারে। অর্থাৎ, রাশিয়ার জ্বালানি ছাড়া আধুনিক অর্থনীতি প্রায় অকল্পনীয়। পুতিন এই বাস্তবতাকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করছেন।
৩. প্রতিরক্ষা ও ভূরাজনীতিতে পুতিনের নতুন বার্তা
পুতিন এবার তিনটি ক্ষেত্রে—
১. অর্থনীতি
২. ইউক্রেন যুদ্ধ
৩. প্রতিরক্ষা সক্ষমতা
সবক্ষেত্রেই শক্ত অবস্থান ঘোষণা করেছেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা রাশিয়াকে দমাতে পারবে না। নিরাপত্তা ও ভূখণ্ড রক্ষায় যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে। হাইপারসনিক মিসাইল, উন্নত ড্রোন ও পারমাণবিক সক্ষমতা নিয়ে রাশিয়া প্রস্তুত।
বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘোষণা শুধু ইউক্রেন নয়, পুরো ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি এক ধরনের কৌশলগত সতর্কবার্তা।
৪. মিউনিখ বিমানবন্দরে ড্রোন আতঙ্ক— ইউরোপের নিরাপত্তা সংকট
ঠিক এই প্রেক্ষাপটেই হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেল জার্মানির অন্যতম ব্যস্ত বিমানবন্দর মিউনিখ। আকাশে অজ্ঞাত ড্রোন দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সব ফ্লাইট স্থগিত। কয়েক ঘণ্টার জন্য কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে বিমান চলাচল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি নাশকতা বা সাইবার-সন্ত্রাসের অংশ হতে পারে। সন্দেহ ঘুরছে রাশিয়ার দিকে, যদিও প্রমাণ নেই। ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে ইউরোপে ড্রোন আতঙ্ক বাড়ছে। ফলে বোঝা যাচ্ছে— ইউরোপ শুধু অর্থনৈতিক সংকটে নয়, নিরাপত্তা নিয়েও চরম উদ্বেগে আছে।
৫. সমন্বিত বিশ্লেষণ
এই চারটি ঘটনা একসঙ্গে রাখলে একটি স্পষ্ট ছবি পাওয়া যায়—
অর্থনীতি ও জ্বালানি খাত: রাশিয়ার তেল ছাড়া বিশ্ব কাঁপবে।
রাজনীতি ও কূটনীতি: পুতিন পশ্চিমাদের ভেতরের সংকট উসকে দিতে চাইছেন।
যুদ্ধ ও নিরাপত্তা: ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপের সীমান্ত ছাড়িয়ে এখন বিমানবন্দর, অবকাঠামো পর্যন্ত টার্গেট করছে।
অর্থাৎ, পুতিন শুধু সামরিক নেতা নন— তিনি এখন জ্বালানি, অর্থনীতি ও ভূরাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে পুরো বিশ্বব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন।
পুতিনের সাম্প্রতিক বার্তাগুলো একদিকে ইউরোপকে শঙ্কিত করছে, অন্যদিকে বৈশ্বিক অর্থনীতিকেও অস্থির করে তুলছে। ড্রোন আতঙ্ক, তেলের দাম, প্রতিরক্ষা হুঁশিয়ারি— সবকিছু মিলিয়ে বিশ্বরাজনীতির ভবিষ্যৎ এখন অনেকটাই নির্ভর করছে মস্কোর সিদ্ধান্তের ওপর। প্রশ্ন একটাই— ইউরোপ কি সত্যিই শান্ত হয়ে ঘুমাতে পারবে?