সব ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দিলো হামাস

হামাসের হাতে অবশিষ্ট জীবিত ১৩ জিম্মির সবাইকে রেড ক্রসের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে হামাসের হাতে জিম্মি জীবিত ২০ জনের সবাইকে মুক্তি দিয়েছে তারা। অন্যদিকে ফিলিস্তিনি কিছু বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তাদের পশ্চিম তীরের রামাল্লা ও গাজায় নেওয়া হয়েছে। তবে তাদের সংখ্যা জানানো হয়নি।  

এদিকে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তির নথিতে সই করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং চুক্তির মধ্যস্থতাকারী তিনি দেশ মিসর, কাতার ও তুরস্কের সরকারপ্রধানরা।  

সোমবার (১৩ অক্টোবর) মিসরের পর্যটন শহর শারম আল শেখে শান্তি সম্মেলনে উদ্বোধনী বক্তব্য শেষে প্রথমে নথিতে স্বাক্ষর করেন। এরপর মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান এবং কাতারের আমির শেখ তামিম স্বাক্ষর করেন।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী (আইডিএফ) দুই ধাপে জিম্মি মুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তবে হামাস প্রথম ধাপের জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, গাজায় সর্বশেষ ৪৮ জন ইসরায়েলি জিম্মি অবস্থায় ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ২০ জন বেঁচে ছিলেন।  ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, মুক্তি পাওয়া সব জিম্মি গাজা থেকে ইসরায়েলে ফিরে এসেছে। 

এর আগে স্থানীয় সময় সকাল ৮টায় প্রথম ধাপে সাত জিম্মিকে রেড ক্রসের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তাঁরা এরই মধ্যে ইসরায়েলে পৌঁছেছেন। জিম্মি ও নিখোঁজ পরিবারগুলোর সংগঠনের তথ্য মতে, মুক্তি পাওয়া জিম্মিরা হলেন গালি বারমান, জিভ বারমান, এইটান আব্রাহাম মর, ওমরি মিরান, মাতান আংগ্রেস্ট, আলোন ওহেল, গাই গিলবোয়া-ডালাল। আর ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, পরের ধাপে মুক্তি পাওয়া ১৩ ইসরায়েলি জিম্মি হলেন এলকানা বোহবোট, জন রোম ব্রাস্লাভস্কি, জন নিমরোড কোহেন, জন এরিয়েল কুনিও, জন ডেভিড কুনিও, জন এভিয়াটার ডেভিড, জন ম্যাক্সিম হারকিন, জন ইতান হর্ন, জন সেগেভ কালফন, জন বার কুপারশটাইন, জন ইউসুফ হাইম ওহানা, জন আভিনাতান ওর এবং জন মাতান জাঙ্গাউকার।

ফিলিস্তিনি প্রিজনার্স সোসাইটি চলমান বিনিময়ের অংশ হিসেবে ইসরায়েলি কারাগার থেকে মুক্তির জন্য নির্ধারিত এক হাজার ৭১৮ জন ফিলিস্তিনির নামও ঘোষণা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সরকারি উড়োজাহাজ এয়ার ফোর্স ওয়ান থেকে টেলিভিশনে জিম্মিদের মুক্তির দৃশ্য দেখেছেন। তাঁর প্রেস সচিব ক্যারোলাইন লেভিট এ তথ্য জানিয়েছেন। আরো ৪৮ জিম্মির মৃতদেহ হামাসের কাছে আছে। সেগুলোও সোমবারের মধ্যেই রেডক্রসের মাধ্যমে ইসরায়েলের কাছে হস্তান্তরের কথা রয়েছে।

জানা গেছে, গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম ধাপে ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে শত শত ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে ইসরায়েল। গতকাল লাইভ প্রতিবেদনে আলজাজিরা জানিয়েছে, ইসরায়েল থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত কিছু ফিলিস্তিনি বন্দিকে বহনকারী বাসগুলো এরই মধ্যে পশ্চিম তীরের রামাল্লায় পৌঁছেছে। তাঁরা বাসের ভেতর থেকে হাসিমুখে বিজয়ের চিহ্ন তৈরি করছে। যানবাহনগুলো ঘিরে রয়েছে অসংখ্য মানুষ। অনেকেই তাদের ফোনে দৃশ্য ধারণ করছে, আর অন্যরা ফিলিস্তিনি পতাকা নাড়ছে। এর আগে, মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিদের বহনকারী কয়েকটি বাস দক্ষিণ ইসরায়েলের নেগেভ কারাগার থেকে গাজার দিকে চলে যায়। এরই মধ্যে কয়েকটি বাস যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলটিতে পৌঁছেছে। আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি (আইসিআরসি) বন্দিবিনিময়ের পুরো প্রক্রিয়াটি তত্ত্বাবধান করছে।

ওদিকে ইসরায়েলের পার্লামেন্ট নেসেটে বক্তব্য রাখার জন্য সেখানে পৌঁছেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। টেকসই শান্তি প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে এই সুযোগকে কাজে লাগাতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার। গতকাল দিনের শেষের দিকে গাজা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে শারম আল শেখে যোগ দেওয়ার কথা তাঁর। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান কাজা কাল্লাস বলেন, গাজা ও মিসরের মধ্যে সীমান্ত ক্রসিং রাফায় মনিটরিং করবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। কাল্লাস এক্সে এক পোস্টে বলেন, গাজায় শান্তি নিশ্চিত করা হবে ব্যতিক্রমী এক জটিল কাজ।

এদিকে ইসরায়েলের সংসদে ট্রাম্পের বক্তৃতায় বাধা দেওয়ার পর দুজন এমপিকে সংসদ থেকে বের করে দেওয়া হয়। তাঁরা হলেন ওফের কাসিফ এবং আয়মান ওদেহ। অপসারণ করা নেসেটের সদস্য ও মুসলিম আয়মান ওদেহ বলেছেন, তাঁকে অপসারণ করা হয়েছে কারণ তিনি ‘সরলতম দাবি উত্থাপন করেছিলেন, এমন একটি দাবি যার ওপর সমগ্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একমত। সেটি হলো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া, এই সরল বাস্তবতাকে স্বীকৃতি দেওয়া।’

পরবর্তী সময়ে ওফের কাসিফ এবং আয়মান ওদেহকে ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্মকর্তারা টেনে-হিঁচড়ে বের করে আনেন, তাঁদের কাছ থেকে ব্যানার ছিনিয়ে নেন। অপসারণের আগে ওদেহ একটি কাগজ তুলে ধরেন, যাতে লেখা ছিল : ‘ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দাও।’ কাসিফও একই পোস্টার ধরেছিলেন। তিনি এক্সে লিখেছেন, ‘আমরা বিরক্ত করতে আসিনি, বরং ন্যায়বিচার দাবি করতে এসেছি। সত্যিকারের শান্তি, যা এই ভূখণ্ডের উভয় মানুষকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করবে কেবল তখনই আসবে, যখন দখলদারি এবং বর্ণবাদের অবসান ঘটবে এবং ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে।’

এদিকে গাজায় যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, তা বাস্তবে পরিণত করে গাজা সিটিতে হামাসের নিরাপত্তা বাহিনী স্থানীয় ইসরায়েলপন্থী দুগমুশ পরিবারের সশস্ত্র সদস্যদের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ শুরু হয়েছে, এতে অন্তত ২৭ জন নিহত হয়েছেন। বিবিসি লিখেছে, ফিলিস্তিনি ছিটমহলটিতে ইসরায়েলের বড় অভিযানগুলো শেষ হওয়ার পর থেকে এটি গাজায় শুরু হওয়া অন্যতম সবচেয়ে সহিংস অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, হামাসের মুখোশ পরা যোদ্ধারা নগরীর জর্দানীয় হাসপাতালের কাছে ওই পরিবারের বন্দুকধারীদের সঙ্গে গুলিবিনিময় করেছে। এ ছাড়া ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গাজা শহরের পশ্চিমে আল-শিফা হাসপাতালের কাছে বিস্ফোরণে তিন শিশু আহত হয়েছে। 

সূত্র : আলজাজিরা, রয়টার্স, বিবিসি