স্বাদের দিক থেকে সুনাম রয়েছে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের পানের। স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি কুষ্টিয়াসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি জেলায় পান সরবরাহ করা হয়। এখন দেশের সীমানা পেরিয়ে অন্য দেশেও রপ্তানি হচ্ছে এই পান। এতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে। লাভবান হচ্ছেন কৃষক।
তবে কৃষকরা বলছেন- এ অঞ্চলে একটি পান গবেষণা কেন্দ্র তৈরি করা সম্ভব হলে পান চাষকে আরও সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি তৈরি হবে নতুন উদ্যোক্তা। এতে যেমন বাড়বে নতুন কর্মসংস্থান, বৃদ্ধি পাবে রপ্তানি। বাড়বে বৈদেশিক মুদ্রা আয়।
স্থানীয় পান বাজারের হিসেব অনুযায়ী, প্রতিদিন দৌলতপুর থেকে ৩-৪ টন পান রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। যা রপ্তানিকারকদের কাছে ৫০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করেন ফড়িয়ারা।
ভৌগোলিক ও উপকরণের সহজলভ্যতার কারণে দীর্ঘদিন এ অঞ্চলের চাষিরা অর্থকরী ফসল হিসেবে পান চাষ করে আসছেন। অন্য ফসল চাষাবাদের পাশাপাশি হাজার খানেক কৃষক পান চাষে জড়িত। কয়েক বছর ধরে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, জর্ডানসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে রপ্তানি হচ্ছে কুষ্টিয়ার পান।
তবে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, পান চাষকে আরও সমৃদ্ধ করতে কাজ করছেন তারা। সরকারিভাবে এসব পান বাইরে রপ্তানির উদ্যোগও হাতে নেওয়া হয়েছে। যা দ্রুত কার্যকর হবে। এর ফলে আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় সম্ভব বলে মনে করছেন তারা।
দৌলতপুর উপজেলা কৃষি অফিসের দেওয়া তথ্যমতে, এই অঞ্চলে স্থানীয় বাজার থেকে বছরে পানের আয় অন্তত ১২ কোটি টাকা। উপজেলাটিতে পান চাষ হয় প্রায় ৪৯০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় উপজেলার মথুরাপুর ইউনিয়নে। তবে বিদেশে পান রপ্তানির সঠিক হিসেব নেই এই অফিসে।
পান চাষকে কেন্দ্র করে এই উপজেলায় গড়ে উঠেছে দুটি পান বাজার ও হাট। সেখান থেকে চাষিদের কাছ থেকে ফড়িয়া বা আড়তদাররা পান কিনে দেশের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেন। মাঝে মাঝে অন্যান্য অঞ্চলের ব্যবসায়ীরাও এসব বাজার থেকে পান কিনে নিয়ে যায়। দেশে ৮০টি পান পাতাকে এক বিড়া বা এক পন হিসেবে বিক্রি করা হয়। পানের এসব ক্ষেতকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় ‘পান বরজ’। চাষিরা বরজ থেকে পান ভেঙে বাজারে বিক্রি করে থাকেন।
পান চাষ নিয়ে কথা হয় কয়েকজন প্রবীণ পান চাষিদের সাথে যারা দুই যুগের বেশি সময় ধরে এই চাষের সাথে জড়িত তাদের মধ্যে একজন নজু ইসলাম। তিনি জানান, বর্তমানে পানের বাজার দর ভালো। স্থানীয় বাজারে ১০০ থেকে ১২০ টাকা পন বা বিড়াতে বিক্রি হচ্ছে। আর যে পান রপ্তানির জন্য ফড়িয়ারা নিচ্ছেন সেটা ১৫০-১৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। পান বাইরে রপ্তানি শুরুর পর থেকে ভালো লাভের কথা জানান তিনি।
কালু নামের তারাগুনিয়া এলাকার আরেক চাষি জানান, আধুনিক পদ্ধতিতে পান চাষ করা গেলে রপ্তানিযোগ্য পানের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে। কুষ্টিয়ায় পান গবেষণা কেন্দ্র থাকলে আরও ভালো পরামর্শ নেওয়া সম্ভব হতো বলে জানান তিনি।
রপ্তানির জন্য পান সংগ্রহ কারকদের বলা হয় ফড়িয়া (ব্যবসায়ী)। আর সেই পানকে বলা হয় ‘সাপ্লাই পান’। পলাশ নামের এক ফড়িয়া জানান, রপ্তানিযোগ্য পান সরাসরি চাষিদের ‘বরজ’ থেকে সংগ্রহ করা হয়। যেসব চাষি সাপ্লাই পান বিক্রি করতে ইচ্ছুক, তারা ফড়িয়াদের সংবাদ দেন। ফড়িয়ারা ক্ষেতে গিয়ে নিজস্ব লোকজন দিয়ে পান সংগ্রহ করেন।
তিনি আরও বলেন, রপ্তানির জন্য সব ক্ষেত থেকে পান সংগ্রহ করা হয় না। আকারে বড়, ওজনে ভালো, সুন্দর রঙ এবং রোগবালাইমুক্ত পান সংগ্রহ করা হয়। চলতি বাজার মূল্যের তুলনায় বেশি দামে এসব পান ক্রয় করা হয়।
এ সময় তিনি আরও বলেন, ক্ষেতের সেরা পানগুলোই নেওয়া হয়। ফড়িয়ারা সারাদিন ক্ষেত থেকে পান সংগ্রহ করে ঢাকায় রপ্তানিকারকদের কাছে পৌঁছে দেন। দিন দিন রপ্তানি পানের চাহিদা বাড়ছে। দৌলতপুর থেকে প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ টন পান সৌদি আরব, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাঠানো হচ্ছে। যা ঢাকা এয়ারপোর্টে বিক্রি হয় ৫০০ টাকা কেজিতে।
তবে বেশি দামে পান বিক্রি করতে পেরে খুশি চাষিরা। চাষি বাদশা সর্দার ও বাবু জানান, দীর্ঘদিন দাম হতাশাজনক থাকার পর পানের দাম বেড়েছে। পান এখন বিদেশে যাচ্ছে। দাম এমনই থাকবে। নতুন নতুন পানের ক্ষেতও তৈরি হবে।
এ বিষয়ে দৌলতপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম জানান, দৌলতপুরে ৪৯০ হেক্টর জমিতে পানের চাষ হয়। এতে স্থানীয় বাজার থেকে বছরে অন্তত ১২ কোটি টাকা আয় হয়। তবে বিদেশে রপ্তানির বিষয়টি আমাদের জানা নেই।
কুষ্টিয়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. হায়াত মাহমুদ জানান, জৈব পদ্ধতিতে নিরাপদ পান উৎপাদনে কৃষি অফিস পান চাষিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছে। কুষ্টিয়া থেকে প্রচুর পান বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে এখন। সরকারিভাবে পান বাইরে রপ্তানির উদ্যোগ হাতে নেওয়া হয়েছে। আর এটি দ্রুত কার্যকর হবে। যার ফলে আরও বৈদেশিক মুদ্রা আয় সম্ভব হবে। এতে কৃষকরা আরও বেশি লাভবান হবে।
পান চাষের সাথে জড়িত এ অঞ্চলের দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরাও এখন সচ্ছল। লেখাপড়ার পাশাপাশি সকাল ৬টা থেকে ৮টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টা পান বরজে কাজ করে প্রায় ২০০ টাকা আয় করে তারা। তাই এই পান চাষের ওপর সংশ্লিষ্টের নজরদারি বাড়লে এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন অনেকে।
