জাতীয় মাছ ইলিশের অস্তিত্ব রক্ষা ও উপকূলীয় পরিবেশ সুরক্ষার দাবিতে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় আন্ধারমানিক নদীতে গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সোমবার (১০ নভেম্বর) সকাল ১০টায় প্রতিবেশ ও উন্নয়ন ফোরাম পটুয়াখালী, প্রান্তজন, ক্লিন ও বিডব্লিউজিইডি যৌথ উদ্যোগে এ গণশুনানির আয়োজন করে। এই শুনানিতে এলাকার জেলে পরিবার ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।

আয়োজক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়, জাতীয় মাছ ইলিশের উৎপাদন দিন দিন কমছে: ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত উৎপাদন স্থিতিশীল থাকলেও ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসে ইলিশের জাতীয় উৎপাদন ৪২,০০০ মেট্রিকটন কমে গেছে (প্রায় ৮% হ্রাস), যা গত ৬ বছরের মধ্যে ইলিশ উৎপাদন তলানিতে নেমে আসার ইঙ্গিত। দেশের মোট ইলিশের প্রায় ৬৫% উৎপাদনকারী বরিশাল বিভাগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে (প্রায় ২৩,৫০৯ মেট্রিকটন হ্রাস)। একসময়ের অফুরন্ত ভান্ডার আন্ধারমানিক নদ আজ গভীর সংকটের মুখে এবং ২০১১ সালে অভয়াশ্রম ঘোষিত এই নদীতে বর্তমানে কালেভদ্রেও ইলিশ মিলছে না। এই গভীর সংকটের কেন্দ্রে রয়েছে এই অঞ্চলের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও পায়রা বন্দর কেন্দ্রিক অপরিকল্পিত উন্নয়ন।
বক্তারা জোর দিয়ে বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অন্যান্য অবকাঠামো থেকে নির্গত অপরিশোধিত শিল্প বর্জ্য ও গরম পানি সরাসরি নদীতে পড়ছে।

মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ইলিশ অত্যন্ত দূষণ সংবেদনশীল হওয়ায় এই দূষণ তার প্রজনন ব্যাহত করছে, ফলে ইলিশের আকার ছোট হচ্ছে এবং তারা এলাকা ছাড়ছে। এই দূষণের কারণে রামনাবাদ, আন্ধারমানিক ও টিয়াখালী নদীর পানি ও মাটি মাঝারি থেকে উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। পাশাপাশি, বন্দরকে কেন্দ্র করে নদীতে অতিরিক্ত জাহাজ চলাচল বৃদ্ধি পাওয়ায় ইলিশের বঙ্গোপসাগর থেকে মূল প্রবেশ পথ প্রায় অবরুদ্ধ হচ্ছে।
এছাড়াও আন্দারমানিক নদীতে মাত্র ৮ থেকে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে একের পর এক তিনটি সেতু নির্মাণ এবং শাখা নদীগুলোর মুখ বন্ধ হওয়ায় নদীর স্বাভাবিক স্রোত বাধাগ্রস্থ হয়ে নাব্যতা কমেছে, যা ইলিশের অবাধ বিচরণ ও প্রজননকে মারাত্মকভাবে বাধা দিচ্ছে। এছাড়া নদীর তীর ভরাট করে ফ্রি—স্টাইলে বালু ফেলা এবং অবৈধ দখলদারিত্ব চলছে, যা নদীটিকে অস্তিত্ব সংকটে ফেলেছে।

জেলে আব্দুর রব রাঢ়ী বলেন, আমি প্রায় ৫৫ বছর ধরে মাছ ধরি। মধুপাড়া, চর নিশানবাড়িয়া, দেবপুর, ছোনখোলা গ্রামে আমার মতো ১০০০ জেলে এক সময় রামনাবাদ নদীতে মাছ ধরে তাদের জীবন ধারণ করতো। এখন রামনাবাদ নদীর পায়রা বন্দরের চ্যানেল করে আমাদেরকে আর মাছ ধরা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু কোন ক্ষতিপূরণ দেয়নি। এখন আমাদের বেঁচে থাকাই কষ্ট।
গণশুনানীতে জেলেদের পরিবারের মধ্যে আলোচনা করেন, মন্নান পলহান, আব্দুর রব রাঢ়ী, আকলিমা, চন্দ্র ভানু, জহিরুল ইসলাম।

গণশুনানীর বিচারক প্যানেলে ছিলেন- ড. মোহাম্মদ আশরাফুল হক উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও উপকেন্দ্র প্রধান, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট নদী উপকেন্দ্র খেপুপাড়া, অসীম আবরার প্রভাষক উপকূলীয় অধ্যয়ন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, এডভোকেট সুভাস চন্দ্র দাস, অমল মুখার্জী আহ্বায়ক, নজরুল ইসলাম সদস্য সচিব ও মেজবাহ উদ্দিন মাননু সদস্য প্রতিবেশ ও উন্নয়ন ফোরাম পটুয়াখালী, তৌহিদুল ইসলাম শাহজাদা নির্বাহী পরিচালক প্রান্তজন।
বক্তারা স্পষ্ট করে তুলে ধরেন যে, কলাপাড়া অঞ্চলে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও পায়রা বন্দর কেন্দ্রিক অপরিকল্পিত মেগাউন্নয়নই ইলিশের অভয়াশ্রম আন্ধারমানিক নদীকে আজ ইলিশ শূন্য হওয়ার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে।
