প্রতিবছরই স্কুল-কলেজের বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তক নিয়ে নানা ধরনের বিতর্ক লক্ষ করা যায়। সম্প্রতি সপ্তম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ পাঠ্যবইতে ‘শরীফা গল্প’ নিয়ে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন প্রায় সবাই। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় এ বিষয়ে সমালোচনার ঝড় শুরু হলে ঘুম ভাঙে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। ইতোমধ্যে ‘শরীফা গল্প’ পর্যালোচনায় পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটা কমিটি গঠন করেছে মন্ত্রণালয়। কমিটির কাজ হবে ‘শরীফা গল্প’ নিয়ে উদ্ভূত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ওই বিষয়ে আরও গভীরভাবে পর্যালোচনা করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে (এনসিটিবি) সহায়তা করা।
এদিকে গত ১ ফেব্রুয়ারি ‘শরীফা গল্প’ বাদ দিতে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মাহমুদুল হাসান। ওই নোটিশটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবির) চেয়ারম্যানকে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
‘শরীফা গল্প’ নিয়ে চারদিকে বিতর্ক শুরু হওয়ার পর থেকে দেশের বিভিন্ন জেলা, বিভাগীয় শিক্ষক ও অভিভাবকদের সাথে কথা বলেছে খবর সংযোগ। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য কেমন পাঠ্যবই চাই? এই প্রশ্নে তারা জানান, নির্ভুল ও সুপ্রণীত হওয়া উচিত বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকগুলো। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ঢাকা, মহাসচিব জসিম উদ্দিন আহমেদ বলেন, পাঠ্য বইয়ের ভুলের অভিযোগ ও বিতর্ক এবারই প্রথম নয়, প্রতিবছরই এমন অভিযোগ ওঠে। বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে যে নতুন বই পৌঁছে দেওয়া হয় তা শতভাগ নির্ভুল প্রণয়ন ও মুদ্রণের ব্যবস্থা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে আর সমালোচনা-বিতর্ক সৃষ্টি হবে না।
কথা হয়েছে চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগীয় শিক্ষক সমিতির শিক্ষকদের সাথেও। খবর সংযোগকে তারা জানান, পাঠ্যপুস্তকে শুধু ভুলত্রুটি নয়, আগে পড়ানো হতো এমন কিছু গল্প, কবিতা কিছু বই থেকে বাদ দেওয়ার কারণেও বিতর্ক লক্ষ করা যাচ্ছে। এতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সরকারকে বিতর্কিত করছে।
তাদের কথা, যেকোনো দেশের শিক্ষাক্রমের পাঠ্যসূচি ওই দেশের জাতীয় চেতনা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, দেশপ্রেম ও দীর্ঘদিনের লালিত ঐতিহ্য ধারণ করে। বিশেষ করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচিতে তা সযত্নে রাখা উচিত। যাতে তারা দেশের আগামী দিনের সম্পদে পরিণত হয়। শিশু-কিশোরদের দেশপ্রেম, ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়াই পাঠ্যসূচির প্রধান উপজীব্য বিষয় হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন শিক্ষকরা।
কিছু কিছু লেখায় সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ও ভরপুর যৌনতার প্রকাশ ঘটেছে বলেও শিক্ষকদের পাশাপাশি অভিযোগ অভিভাবকদের। যা কোনোভাবেই কোমলমতি শিশুদের জন্য উপযোগী নয়। ছোট ছোট শিশুদের জেন্ডার ইস্যুর মধ্যে টেনে আনা হচ্ছে। এটাকে সমস্যাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি বলে অবশ্যই মনে হতে পারে। শিক্ষক ও অভিভাবকরা ইতোমধ্যে হাস্যকর বলেও মন্তব্য করেছেন। শিক্ষা ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছেন অভিভাবকরা। বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে ভুলের বিষয়ে লেখক ও এনসিটিবিকে দায় নিতে হবে বলেও জানিয়েছেন শিক্ষার্থীদের পিতা-মাতারা।
পাঠ্যবইতে বিভিন্ন সাইট বা ব্লগ থেকে কপি ও ভুয়া কল্পকাহিনির অভিযোগ এনে নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর বাবা বলেন, বর্তমানে পাঠ্যবইগুলো দেখলে মনে হয়, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। মুক্তচিন্তা ও ধর্মীয় পরিচয়কে হেয় করা হচ্ছে। এসব কপি ও ভুয়া কল্পকাহিনি পড়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনেক বড় বিপদের সম্মুখীন হতে হবে। আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন নান্দনিক জিনিস তৈরি করে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট দেওয়ার মতো করে গড়ে তুলতে হবে। পাঠ্য বই থেকে দ্রুত বিতর্কের বিষয়গুলো সংশোধনের জোর দাবিও জানান তিনি।
সপ্তম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থীর বাবা বলেন, দেশের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার দরকার। শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কে ভালো ধারণা দেওয়ার মতো লোক এবং জাতি গঠনে নির্ভুল ও সমালোচনাহীন পাঠ্যপুস্তক সম্পাদনায় আরও ভালো অভিজ্ঞ গুণীদের প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও লক্ষ্যের সাথে কায়েমি স্বার্থবাদীদের অনেক পার্থক্য। দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসন করে নতুন পাঠ্যপুস্তক আনতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
