ব্রিটিশ উইভিং স্কুল থেকে ইস্ট বেঙ্গল টেক্সটাইল ইন্সটিটিউট, ইস্ট বেঙ্গল টেক্সটাইল ইন্সটিটিউট থেকে ইস্ট পাকিস্তান টেক্সটাইল ইন্সটিটিউট। সর্বশেষ কলেজ অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়। বলছিলাম বাংলাদেশের একমাত্র বিশেষায়িত বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) কথা। রাজধানীর তেঁজগাওয়ে অবস্থিত ১১.৬৭ একরের এই ক্যাম্পাসের আদিযাত্রা ১৯২১ সালে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু ২০১০ সালের ২২ ডিসেম্বর। দীর্ঘ যাত্রাকালে বুটেক্স থেকে পড়াশোনা করে বেরিয়েছেন অনেক শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে কেউ কেউ টেক্সটাইল খাতেই অর্জন করেছেন সাফল্য। আবার কেউ কেউ টেক্সটাইল খাতের বাইরেও অর্জন করেছেন সুনাম। তাদের কেউ হয়েছেন উদ্যোক্তা, কেউ ব্যবসায়ী, কেউবা আবার বিসিএস ক্যাডার। বুটেক্সের এমনই কয়েকজন কৃতী শিক্ষার্থীকে নিয়ে থাকছে বিস্তারিত।
রুবায়েত ইসলাম
টেক্সটাইল খাতের বাইরেও অন্যান্য সেক্টরে সাফল্যের চূড়ায় আরোহন করতে পারে তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ রুবায়েত ইসলাম। রুবায়েত ইসলাম নাসায় (NASA) প্রিন্সিপাল ডাটা সায়েন্টিস্ট হিসেবে কর্মরত। তিনি বুটেক্সের ২৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। বুটেক্স থেকে বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব লুটন থেকে এমবিএ করেন। এরপর ইংল্যান্ডের হেরিয়ট ওয়াট ইউনিভার্সিটি থেকে ফ্যাশন ডিজাইনিং এর উপর এমএসসি সম্পন্ন করেন। কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ অন্টারিও ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ এমএসসি সম্পন্ন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ ম্যারিল্যান্ড থেকে ডাটা সায়েন্স অ্যান্ড ম্যাশিন লার্নিং এর উপর পিএইচডি সম্পন্ন করেন। এক পর্যায়ে তিনি উপলব্ধি করেন তার অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা ডাটা সায়েনটিস্ট হওয়ার জন্য উপযোগী এবং পরবর্তীতে তিনি নাসায় প্রিন্সিপাল ডাটা সায়েন্টিস্ট হিসেবে যোগদান করেন। নাসায় যোগদানের পূর্বে তিনি ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব ফিন্যান্স, সিএমএস, জেনারেল সার্ভিস এডমিনিস্ট্রেশনসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থায় কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউজের স্ট্যাটিস্টিকাল মডেল বিল্ডিং নিয়েও কাজ করেছেন।
তারান্নুম আফরীন
ড. তারান্নুম আফরীন একাধারে একজন বিজ্ঞানী, সঙ্গীতশিল্পী, কবি , বিতার্কিক ও উপস্থাপক। বুটেক্সের ২৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে বিএসসি পাস করেন। কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পেয়ে যুক্তরাজ্যে ম্যানচেস্টার মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি থেকে প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্টে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। অতপর পাড়ি জমান অস্ট্রেলিয়ায়। অস্ট্রেলিয়ার ডেকিন ইউনিভার্সিটি থেকে ম্যাটেরিয়ালস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি করেন। তার গবেষণার বিষয়বস্তু ছিলো ফাইবার প্রসেসিং। তবে এর পাশাপাশি তিনি ন্যানো টেকনোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, সাসটেইনেবেলিটি নিয়েও কাজ করেছেন। ফাইবার নিয়ে গবেষণা করে যুক্ত্ররাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায় বেশ আলোচিত হয়েছেন। তার করা প্রজেক্ট কে ‘ব্রেকথ্রু’ বা মাইলফলক বলে অভিহিত করা হয় বিভিন্ন প্রতিবেদনে। ‘বেস্ট ডক্টরাল থিসিস’র জন্যে তিনি পেয়েছেন আলফ্রেড ডেকিন মেডেল। বাঁশের ফাইবার নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে তিনি এমন একটি ক্যামিকেল কম্পাউন্ড শনাক্ত করেছেন যা সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রক্ষা করবে মানুষকে। টেক্সটাইলে যে ধরনের কাজ করতে হয় তা নারীবান্ধব নয়- এমন ধারণার বিপরীতে চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করছেন তারান্নুম আফরীন।
ইকরা ইফতেখার শুভ
ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) মিডিয়া ল্যাবে পিএইচডি করছেন বুটেক্সের ৩৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ইকরা ইফতেখার শুভ। তিনি বুটেক্স থেকে বিএসসি সম্পন্ন করে কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবা থেকে বায়োসিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের উপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবার ডিপার্টমেন্ট অব বায়োসিস্টেমস টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্র্যাজুয়েট রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট এবং কানাডার ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টাতে ডিপার্টমেন্ট অব হিউম্যান ইকোলজিতে গ্র্যাজুয়েট রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট ফেলো হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বোয়িং কানাডায় (BOEING Canada) কাজ করে এয়ারক্রাফটের কম্পোজিট ফেব্রিকেশন টেকনোলজি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। বর্তমানে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) গ্র্যাজুয়েট রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট হিসেবে কনফর্মেবল ডিকোডার রিসার্চ গ্রুপে কাজ করছেন। তিনি মিডিয়া ল্যাবের ক্লাস-২০২৫ থেকে হেরল্ড হরোভিটজ (১৯৫১) স্টুডেন্ট রিসার্চ ফান্ডে পুরস্কারপ্রাপ্তির জন্য মনোনীত হয়েছেন। হেরল্ড হরোভিটজ এমআইটির আর্কিটেকচার এবং প্লানিং স্কুলের একটি গবেষণ বিষয়ক তহবিল। তার বর্তমান গবেষণার বিষয়, ‘Micro-fabricating piezoelectric ultrasound transducer for imaging tumor.’ টেক্সটাইলে স্নাতক করে বিশ্বের নামকরা প্রথমসারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও যে উচ্চশিক্ষা অর্জন করা যায় তার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ইকরা ইফতেখার শুভ।
শানিরুল ইসলাম শাওন
৪৩তম বিসিএস এ প্রশাসন ক্যাডারে প্রথম স্থান অধিকার করেন বুটেক্সের শিক্ষার্থী শানিরুল ইসলাম শাওন। তিনি বুটেক্সের ৪০তম ব্যাচের এ্যাপারেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। বাড়ি সিলেটের হবিগঞ্জ জেলায়। তিনি বলেন, টেক্সটাইল প্রকৌশলের শিক্ষার্থী হওয়ায় আর টেক্সটাইল সেক্টর অনেক বড় হওয়ায় চাকরির তেমন চিন্তা ছিলো না। কিন্তু গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর পরিবারের সিদ্ধান্ত আসে বিসিএস দেওয়ার জন্য। পরিবারের স্বপ্নপূরণের জন্য তিনি ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে ঢাকায় ফিরে কোচিংয়ে ভর্তি হোন। পুরোদমে নেমে পড়েন চাকরির প্রস্তুতিতে। বিসিএস-এর সার্কুলারে একটা কথা তাকে আরও বেশি উৎসাহ জোগাতো। সেটা হচ্ছে, ‘যথাযথ জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে অংশগ্রহণ করুন এবং নির্বাচিত হয়ে দেশ সেবার পবিত্র সুযোগ লাভ করুন।’নিয়মিত পরিশ্রম, ধৈর্য্য ও অধ্যাবসায়কে পুঁজি করে শাওনের এই অর্জন এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
ফয়সাল মাহমুদ মার্টিন
ফয়সাল মাহমুদ মার্টিন বুটেক্সের ৩৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। বর্তমানে তিনি এইচ অ্যান্ড এম (H&M) কোম্পানিতে সিনিয়র মার্চেন্ডাইজার হিসেবে কর্মরত আছেন। এইচ অ্যান্ড এম হলো সুইডেনে অবস্থিত একটি বহুজাতিক পোশাক কোম্পানি যা ফাস্ট-ফ্যাশন পোশাকের জন্য সুখ্যাতি অর্জন করেছে। একজন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারের জন্য এইচ অ্যান্ড এম এ কাজ করার সুযোগ পাওয়াটা অনেক গর্বের ও আনন্দের। বুটেক্স থেকে বিএসসি সম্পন্ন করে শুরুতে তিনি গাজীপুরে ইন্টারস্টোফ অ্যাপারেলস লিমিটেড কোম্পানিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট মার্চেন্ডাইজার হিসেবে প্রায় দেড় বছর কাজ করেন। এরপর ঢাকায় এস কিউ গ্রুপে মার্চেন্ডাইজার হিসেবে ১ বছর দায়িত্ব পালনের পর সি অ্যান্ড এ সোর্সিং (C&A Sourcing) কোম্পানিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট মার্চেন্ডাইজার হিসেবে কাজ করেন। তারপর নেক্সট সোর্সিং লিমিটেড কোম্পানিতে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করেন ও সেখানে মার্চেন্ডাইজ প্রোডাকশন কন্ট্রোলার হিসেবে ৫ মাস দায়িত্ব পালন করেন।
সাজিদ রহমান
তিনি বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) ৩০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। বর্তমানে অ্যাডিডাস (Adidas) কোম্পানিতে ম্যানেজার ম্যাটেরিয়ালস ইনোভেশন অ্যাপারেল-ম্যাটেরিয়ালস সাস্টেনিবিলিটি - গ্লোবাল অপারেশন্স হিসেবে কর্মরত আছেন। পাশাপাশি তিনি অনলাইন ফুড ডেলিভারি কোম্পানি ‘হাঙরি নাকি’র (HungryNaki) সহ-প্রতিষ্ঠাতা। এর আগে তিনি এইচ অ্যান্ড এম (H&M) কোম্পানিতে ৫ বছর কর্মরত ছিলেন এবং সেখানে ১ বছর সিনিয়র ম্যাটেরিয়াল স্পেশালিস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল লিমিটেড কোম্পানিতে প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট টেকনোলজিস্ট হিসেবে প্রায় এক বছর এবং ইতোচু (itochu) টেক্সটাইল প্রমিনেন্ট (এশিয়া) লিমিটেড কোম্পানিতে ফেব্রিক মার্চেন্ডাইজার হিসেবে দেড় বছরের বেশি সময় কাজ করেন। একজন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার যে একজন সফল উদ্যোক্তা হতে পারেন তার উদাহরণ সাজিদ রহমান।
আবু হাসান
বিশ্বের নামকরা ক্রীড়া পোশাক প্রস্তুতকারী বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান গুলোর মধ্যে একটি হলো পুমা (PUMA)। পুমা জার্মান বহুজাতিক কর্পোরেশন যেটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ক্রীড়া পোশাক প্রস্তুতকারক। একজন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান হতে পারে পুমা, এডিডাস এবং নাইকির মতো ক্রীড়াপোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। বুটেক্সের ৩০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আবু হাসান যিনি বর্তমানে কর্মরত আছেন পুমা গ্রুপে ফেব্রিক এপারেল বিভাগের এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে। এর আগে তিনি ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সিনিয়র প্রোডাকশন অফিসার হিসেবে ডিবিএল গ্রুপে কর্মরত ছিলেন। ২ বছর তিনি Dewhirst গ্রুপে ফেব্রিক টেকনোলজিস্ট হিসেবে কাজ করেন। আবু হাসান তার পরিশ্রম, অধ্যাবসায় ও একাগ্রতার মাধ্যমে নিজেকে টেক্সটাইল সেক্টরে একজন দক্ষ টেকনিক্যাল ব্যক্তি হিসবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
কামরুল হাসান নাহিদ
বিশ্বের নামকরা বহুজাতিক ক্রীড়া পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আডিডাস (Adidas) অন্যতম। খেলাধুলার সামগ্রী প্রস্তুতকারী জার্মান বহুজাতিক এই প্রতিষ্ঠানটি ক্রীড়া সামগ্রী তৈরিতে বিশ্বে প্রথম স্থান অধিকারী। বর্তমানে আডিডাসে প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত আছেন বুটেক্সের ৩৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী কামরুল হাসান নাহিদ। তিনি বুটেক্সের ইয়ার্ণ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কেটিংয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এরপর পাড়ি জমান জার্মানি। সেখানে হোকশূলে নাদারাইন ইউনিভার্সিটি থেকে টেক্সটাইল ট্রেড অ্যান্ড টেকনোলজিতে স্নাতকোত্তর করেন।
