চলতি বছরের (২০২৫) ১৮ ফেব্রুয়ারিতে ছয় দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবিগুলো হলো- উপাচার্যের পদত্যাগ, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ, হামলাকারীদের শাস্তি নিশ্চিতকরণ, হল খুলে দেওয়া এবং শিক্ষা কার্যক্রম পুনরায় চালু করা।
পরবর্তী সময় শিক্ষার্থীদের ছয় দফা আন্দোলন এক দফা অর্থাৎ উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে রূপ নেয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বুধবার (২৩ এপ্রিল) দিবাগত রাতে উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ মাছুদকে অব্যাহতি দেয় সরকার। একইসঙ্গে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস কে শরীফুল আলমকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়।
আন্দোলনের শুরু থেকে ভিসি-প্রোভিসি পদত্যাগ পর্যন্ত যা ঘটলো:
আন্দোলনের শুরু
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) ক্যাম্পাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের শুরু হয়। একপর্যায়ে ক্যাম্পাসের আশপাশের এলাকায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। বিকেল ৫টা পর্যন্ত দফায় দফায় চলা সংঘর্ষে কমপক্ষে ৩০ জন আহত হন। এর জন্য ছাত্রদলের নেতাকর্মী ও বহিরাগতদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ঘটনার কোনো সুরাহা না করে উল্টো ২২ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা, ৩৭ জনকে বহিষ্কার, হল বন্ধের ঘোষণা দেয়। এতে শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। শিক্ষার্থীরা ছয় দফা দাবিতে আন্দোলন নামে। শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন দেশব্যাপী একাত্মতা প্রকাশের পাশাপাশি প্রশাসনের ওপর চাপ বেড়ে যায়।

উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি
২৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জরুরি সিন্ডিকেট সভায় কুয়েটের সব আবাসিক হল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরদিন সকাল ১০টার মধ্যে সব শিক্ষার্থীকে হলত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর আবাসিক হলগুলো খুলে দেওয়ার দাবিতে ১৩ এপ্রিল বিকেল থেকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন জোরালো হয়। পরদিন ১৪ এপ্রিল রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় সংঘর্ষে জড়িত থাকার অভিযোগে ৩৭ শিক্ষার্থীকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্তের কথা জানায় কর্তৃপক্ষ।
এরপর ১৫ এপ্রিল শিক্ষার্থীরা উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ মাছুদের পদত্যাগের এক দফা দাবির ঘোষণা দেন। ঘোষণার পর আন্দোলনকারীরা কুয়েটের ছেলেদের ছয়টি হলের তালা ভেঙে হলগুলোয় প্রবেশ করেন। ১৭ এপ্রিল উপাচার্যের পদত্যাগে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেওয়া হয় এবং বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে পদত্যাগ না করলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা আমরণ অনশনে বসার ঘোষণা দেন। ২১ এপ্রিল আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু করেন শিক্ষার্থীরা।
উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ মাছুদের বক্তব্য
আন্দোলনের পুরোটা সময় চুপ থাকলে শেষ মুহূর্তে পদত্যাগের বিষয়টি তার নিজের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে না বলে জানিয়েছিলেন উপাচার্য মুহাম্মদ মাছুদ। গণমাধ্যমকে তিনি জানান, সরকার তাকে সরিয়ে না দিলে তিনি পদত্যাগ করবেন না।
উপাচার্য মুহাম্মদ মাছুদ তখন বলেন, আমাকে সরকার নিয়োগ দিয়েছে। এখন সরকার যদি মনে করে আমি এই পদের জন্য যোগ্য না, অবশ্যই আমি তো আর থাকতে পারবো না। এটা সম্পূর্ণ সরকারের ওপর নির্ভর করছে। এটা এখন আমার ওপর নির্ভর করছে না।

কী বলেছেন শিক্ষা উপদেষ্টা
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে বুধবার (২৩ এপ্রিল) সকালে কুয়েট ক্যাম্পাসে যান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার। সকাল পৌনে ১০টার দিকে শিক্ষা উপদেষ্টা কুয়েট ক্যাম্পাসে পৌঁছে অনশনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আধাঘণ্টারও বেশি সময় ধরে কথা বলেন। কীভাবে ছয় দফা থেকে আন্দোলন উপাচার্য পদত্যাগের এক দফা দাবিতে এলো, সেই বিষয়টিও শিক্ষার্থীরা জানান উপদেষ্টাকে।
পরে উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে পরিস্থিতি এ পর্যায়ে এসে গেছে। ছাত্রদের অনশন করতে হচ্ছে। আমি এখানে একজন পিতা হিসেবে এসেছি। আমি তাদের বলেছি যারা বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছে তারা যেন পানি পান করে। আর যারা সুস্থ আছে, তারা অনশন পালন করুক। কিন্তু তারা সেটা শোনেনি। তারপরও আমি তাদের অনুরোধ করছি, তারা যেন অনশন ভাঙে। আমি আশা করছি, যত দ্রুত সম্ভব তাদের এই সমস্যা সমাধান হবে।

সি আর আবরার বলেন, তারা চাচ্ছে আমরা এখনই কোনো ঘোষণা দেই যার মাধ্যমে তারা অনশন ভাঙতে পারে। আমি তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছি আইনি কিছু বিষয় রয়েছে। আমরা যাই করি না সেটা আইন দ্বারা নির্দিষ্ট হতে হবে।
কুয়েট আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাছুদের পদত্যাগের এক দফা দাবি এবং শিক্ষার্থীদের চলমান আমরণ অনশন কর্মসূচির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে ক্লাস বর্জন ও মহাসড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে সংহতি জানিয়েছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
তাদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন বুয়েট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
