নুরুল কবীর : লামা উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নের একটি পাহাড়ের ৫০একর জায়গার মাটি কেটে সাবাড় করা হয়েছে। উঁচু পাহাড়টি এখন পরিণত হয়েছে সমতল ভূমিতে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ। এই পাহাড়ের মাটি গেছে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা অন্তত ২৭টি ইটভাটায়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ফাইতং ইউনিয়নে ছোট বড় ১০টি পাহাড় রয়েছে। ২৭টি ইটভাটার কোনটি পাহাড়ের কোলে, কোনটি কৃষি জমিতে, আবার কোথাও জনবসতি, প্রাকৃতিক ও সামাজিক বন ঘেঁষে গড়ে উঠেছে। মাটির জন্য ভাটার মালিকরা ১০-১৫টি ভেকু মেশিন দিয়ে দিনে-রাতে কাটছেন পাহাড়। মাটি স্তুপ করে রাখার পর ট্রাক দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইটভাটায়। শুধু পাহাড়ের মাটি নয়, ইটভাটায় পোড়ানোর জন্য সাবাড় করা হচ্ছে প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের গাছ পালা।
ফাইতং ইউনিয়নের বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফাইতং এলাকার মানিকপুর অংশে ফোরবিএম, এনআরবি, ইউবিএম, ওয়াইএসবি ও থ্রিবিএম, ফাইভবিএম, এবিসি, এনআরবি ও বিবিএমসহ অন্তত ২০টি ইটভাটা রয়েছে। ফাইতংয়ের পাহাড়ি এলাকায় আরও ৭টির মতো ভাটা আছে। এক প্রকার প্রতিযোগিতা করে এসব এলাকার পাহাড়গুলো কাটছেন ভাটার মালিকরা। এতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ফাইতং ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি এবং ওই ইউনিয়নের সাবেক সদস্য মোক্তার হোসেন। তিনি ওয়াইএসবি ইটভাটার মালিক।
স্থানীয় বাসিন্দা জানে আলম ও রুবেল হোসেন জানিয়েছেন, গত এক বছর ধরে এখানে পাহাড় কাটা অব্যাহত রয়েছে। আশপাশের কয়েকটি পাহাড়ের মাটি কেটে সমতল করে ফেলা হয়েছে। এর মধ্যে একটি পাহাড়ের ৫০একরের বেশি সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছে। বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনকে একাধিকবার জানালেও কোনও ব্যবস্থা নেওয় হয় নি। এর মাঝে একদিন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা দুই-একটি ইট ভাটাকে জরিমানা করে চলে যান। এর পরদিন থেকে শুরু হয় আবার পাহাড় কাটা। যা এখনও অব্যাহত আছে। তবে কোনও কোনও ভাটা মালিক পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের চোখে ফাঁকি দিতে দিনে না কেটে রাতে পাহাড় কাটছে।

এ বিষয়ে ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি মোক্তার হোসেন বলেন, আমরা এ বছর ইটভাটার অনুমোদন নিতে পারিনি। তাই ইট ভাটার কার্যক্রম চালাতে পারবো কিনা জানি না। তবে ইটভাটা প্রস্তুত করে রাখতে হচ্ছে। এজন্য মাটির জোগান দিতে পাহাড়ের কিছু অংশ কাটা হয়েছে। সবাই কাটছে, তাই আমিও কাটছি। কাউকে বাধা দেওয়া যাচ্ছে না।
বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারাও জানেন। ২৭টি ইটভাটা মালিকের কাছ থেকে টাকা তুলে পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে এটা ঠিক নয়। পাহাড় কেটে বন উজাড়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে ফাইতং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক বলেন, উন্নয়নের জন্য ইটভাটার প্রয়োজন আছে। তাই বলে এক ইউনিয়নে এতগুলো ইটভাটার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তারা আমার এলাকার বড় বড় সব পাহাড় সাবাড় করে ফেলছে।
পরিবেশ অধিদপ্তের অনুমতি ছাড়াই এসব ভাটার আশপাশের পাহাড় কাটা হচ্ছে। এ নিয়ে পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, পাহাড় কাটায় জড়িতরা অনেক প্রভাবশালী। তাদের কাছে আমরা অসহায়।
পাহাড় কিংবা বনাঞ্চল ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না জানতে চাইলে লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোস্তফা জাবেদ কায়সার বলেন, ইতোমধ্যে আমরা ফাইতং ইউনিয়নের কয়েকটি ভাটায় অভিযান চালিয়েছি। অভিযানের সময় পাহাড় কাটার প্রমাণ পেলে জরিমানা করা হয়। তবে ওই এলাকা উপজেলা সদর থেকে দূরে হওয়ায় আমরা যখন-তখন চাইলেও যেতে পারি না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে পাহাড় কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ফখর উদ্দিন আহমেদ, তাদের দাবি মিথ্যা। আমরা আগেও তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছি, ইতিমধ্যে ২৩টি ইটভাটার মালিককে ৩১লাখ টাকা জরিমানা করেছি। তবে তাদের সিন্ডিকেট অনেক শক্তিশালী। তারপরও যতটুকু পারছি, ব্যবস্থা নিচ্ছি।
