ঢাকা
মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

জাতীয় কবির চলে যাবার দিন আজ

আপডেট : ২৭ আগস্ট ২০২৩, ১০:১৯ এএম

বিশ্বজিৎ দত্ত ভৌমিক : দ্রোহে ও প্রেমে, কোমলে-কঠোরে বাংলা সাহিত্য ও সংগীতে দিয়েছেন নতুন মাত্রা। কণ্ঠে মানবতার জয়গান। তিনিই জাতীয় কবি কাজী নজরুল  ইসলাম। ১৯৭৬ সালে ঢাকায় পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) এই দিনে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় জাতীয় কবিকে চিরকাল স্মরণ করবে মানুষ।

দারিদ্র্যের কষাঘাত কখনো পরাজিত করতে পারেনি কবিকে। লোভ-লালসা, খ্যাতি, অর্থ, বিত্ত-বৈভবের কাছে মাথা নত করেননি। শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে গেছেন আজীবন। লিখেছেন- কারার ঐ লৌহ কপাট/ ভেঙে ফেল কররে লোপাট... কিংবা লাঞ্ছিত নিপীড়িত জনতার জয় ...../শোষিত মানুষের একতারার জয় ....।

মানবতার মুক্তিই ছিল তাঁর কাছে সবার উর্ধ্বে। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে মুক্তবুদ্ধি ও চিন্তার পক্ষে কলম ধরেছেন নির্ভীক চিত্তে। চয়ন করেছেন ‘চল্ চল্ চল্/উর্ধ্ব গগণে বাজে মাদল...’।

প্রেম, দ্রোহ, সাম্যবাদ ও জাগরণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছে। তিনি লেখাতে যেমন বিদ্রোহী, তেমনি জীবনেও। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে ফেরার পথে নজরুল রচনা করেন ‘বিদ্রোহী’ ও ‘ভাঙ্গার গান’ কবিতা। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’। এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই বাংলা কাব্যে নতুন বাঁক সৃষ্টি করেছিল।

শুধু কবিতাতেই নয়, গান রচনায় নজরুল অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি প্রায় তিন হাজার গান রচনা ও সুর করেছেন। নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন ধ্রুপদি ধারার সঙ্গে। রাগনির্ভর গানকে ভেঙে সাধারণের কাছে সহজবোধ্য ও শ্রুতিমধুর করেছেন। এক রাগের সঙ্গে মিলন ঘটিয়েছেন অন্য রাগের, সংগীতে সৃষ্টি করেছেন নতুন ধারা।

আজীবন বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গি এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠস্বরের কারণে তিনি ভূষিত হন ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে। তিনি কবিতার পঙ্ক্তিমালায় তুলে ধরেছেন নিপীড়িত মানুষের কথা। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার ছিলেন নজরুল।

মুক্তিযুদ্ধে তার গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস। তাঁর কবিতা, গান ও সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক। তার লেখনী জাতীয় জীবনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে।

কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে, ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৯ সনের ১৪ মে)। বাবা কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহেদা খাতুন। ছোটবেলায় তার ডাকনাম ছিল ‘দুখু মিয়া’।

পিতা ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম ও মাজারের মতোয়াল্লি। ফলে ছোটবেলা থেকেই কাজী নজরুল ইসলাম ইসলামিক চিন্তা ও ভাবধারা নিয়ে বড় হয়ে ওঠেন। বাল্যকালে তিনি নিকটস্থ মক্তবে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। বাংলা ও আরবি ভাষার পাশাপাশি স্থানীয় শিক্ষা কেন্দ্রে ফরাসি ভাষাও শেখেন তিনি।

১৯০৮ সালে যখন তাঁর বাবা মারা যান তখন নজরুলের বয়স মাত্র নয় বছর। সংসারে অভাব, অনটন ও দুঃখ দুর্দশায় হাল ধরেন তিনি। ফলে লেখাপড়া প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। জীবিকা অর্জনের জন্য মাত্র দশ বছর বয়সে কাজে নামতে হয় কবিকে। মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি সেখানেই শিক্ষকতা শুরু করেন।

এরপর যোগ দেন লেটো দলে এবং খুব কম সময়ে সুখ্যাতি অর্জন করেন কাজী নজরুল ইসলাম। অসাধারণ প্রতিভা বলে তিনি লেটো দলের প্রধান নির্বাচিত হন এবং গানের দলে থেকেই তিনি বিভিন্ন বইপত্র পড়ে সাহিত্যচর্চায় চালিয়ে যান। সে সময় কবিতা, ছড়া গান ও পালাগান রচনা করে অসম্মান্য দক্ষতার পরিচয় দেন কিশোর নজরুল।

শিক্ষালাপের জন্য গ্রামের কয়েকজন ব্যক্তির সহযোগিতায় রানীগঞ্জ শেয়ারশোল রাজ স্কুলে ভর্তি হন তিনি। শৈশব থেকে চঞ্চল প্রকৃতির নজরুল স্কুলের বাধাধরা নিয়ম কানুন একদমই সহ্য করতে পারতেন না। ফলে হঠাৎ একদিন স্কুল থেকে উধাও হন। আর্থিক অভাব অনটনের কারণে তিনি আসানসলের একটি রুটির দোকানে মাত্র পাঁচ টাকার মাসিক বেতনে চাকরি নেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি কবিতা, গান, গজল ইত্যাদি রচনা করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন বইপত্র পড়ে নিজের জ্ঞান ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে থাকেন। কিশোর নজরুলের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে এক পুলিশ ইন্সপেক্টর তাকে নিয়ে আসেন ময়মনসিংহে। ত্রিশালের দরিরামপুর হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন নজরুলকে। পরবর্তীতে তিনি রানীগঞ্জের শেয়ারশোল রাজ স্কুলেও ভর্তি হয়েছিলেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি নবম শ্রেণী ছাত্র। যুদ্ধের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। ১৯১৯ সালে যোগদান করেন সেনাবাহিনীতে। ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টন রেজিমেন্টের হাবিলদার পদে প্রমোশন লাভ করেন। সৈনিক জীবনে তাকে চলে যেতে হয় পাকিস্তানের করাচিতে। সেনাবাহিনীতে চাকরি করেও কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা ও সাহিত্যচর্চা চালিয়ে গেছেন। করাচীর সেনা নিবাসে এক পাঞ্জাবি মৌলবির সাথে পরিচয় হয় তাঁর। এরপর থেকেই তিনি কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস ও গজল রচনায় বেশি উদ্ধুদ্ধ হন।

১৯১৯ সালের এপ্রিল মাসে পলটন রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়ার পর তিনি ফিরে আসেন মাতৃভূমি চুরুলিয়া গ্রামে। শুরু হয় একনিষ্ঠ কাব্য চর্চা। তার লেখা ছাপা হতে থাকে দৈনিক বসুমতি, মুসলিম ভারত, মাসিক প্রবাসী, বিজলী, ধুমকেতুসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়।

কাজী নজরুল ইসলামের লেখা কবিতা তদানীন্তন রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের জাগরণে তিনি অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। ১৯২১ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে কুমিল্লা থেকে ফেরার পথে তিনি রচনা করেন অমর কবিতা ‘বিদ্রোহী’। যা বাংলার সাহিত্যে তাকে ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে অমর করে রেখেছে।

১৯৪২ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলাম দূরারগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলেন। অসুস্থতা থেকে সুস্থ করে তোলার জন্য দেশের সকল প্রকার চিকিৎসা ব্যর্থ হবার পর ১৯৫৩ সালে সুচিকিৎসার জন্য তাঁকে সরকারি ব্যবস্থায় লন্ডনে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানেও কবিকে রোগমুক্ত করা সম্ভব হয়নি।

১৯৭২ সালের ২৪ মে স্বাধীন বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশে তাঁর বসবাসের ব্যবস্থা করেন। ধানমন্ডিতে কবির জন্য একটি বাড়ি প্রদান করেন। তাঁকে দেওয়া হয় জাতীয় কবির মর্যাদা।

বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাজী নজরুলকে ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি তাঁকে দেওয়া হয় একুশে পদক। কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে। ৭৭ বছর বয়সে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

কবি নজরুল তাঁর কবিতায় লিখেছিলেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই,/যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই’। সেই বিবেচনাতেই কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করা হয়।

BS
আরও পড়ুন