ঢাকা
মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজন শিক্ষিত নাগরিক

আপডেট : ০৮ মে ২০২৫, ০৫:৩০ পিএম

একটি দেশ বা জাতি কতটা এগিয়েছে সেটা বুঝতে হলে সুনির্দিষ্ট কিছু খাত বা বিষয়ের ওপর দৃষ্টি রাখা যেতে পারে। দেশের শিক্ষা খাত তারমধ্যে অন্যতম। একটি দেশের শিক্ষার হার যত বেশি, সে দেশের এগিয়ে যাবার প্রবণতা তত বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক। আধুনিক বা উন্নত বিশ্বের অংশ হতে গেলে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কোনো বিকল্প নেই। দেশকে এগিয়ে রাখতে হলে এগুতে হবে জ্ঞান-বিজ্ঞানে।

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আসলে কতটা এগিয়েছে প্রশ্নটি যে কেউ তুলতেই পারেন। কিন্তু সুদুত্তর মিলবে কি? বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায় আমরা কতটা পিছিয়ে আছি। বাংলাদেশের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনকি এশিয়ার দেশগুলোর শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকাতেও আমরা এখন আর নেই! অথচ একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হতো প্রাচ্যের অক্সফোর্ড! সেই সুদিন যেন ফুরিয়ে গেছে। আমরা পিছিয়ে পড়ছি ক্রমশ। কেন এভাবে পিছিয়ে পড়ছি গুরুত্ব দিয়ে কেউ ভাবছি না।

পাশের হার আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়লেই আমরা শিক্ষিত জাতি হয়ে উঠব, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। কীভাবে চলছে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো! কেউ কি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছেন! শিক্ষা মন্ত্রণালয় কি সবদিকে সমানভাবে নজর রাখতে পারে! নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা কি সবাই যোগ্য! সবাই কি নিয়মিত ক্লাস নেন! সবচেয়ে বড় প্রশ্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডিতে কারা থাকেন! তাদের যোগ্যতা কী! তাদের অনেকেই হয়তো যোগ্য। কিন্তু সবাই কি সমান যোগ্য! শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডিতে থাকার মতো যোগ্যতা কি তাদের সবার আছে! প্রশ্নগুলো অনেক দিনের। কিন্তু জবাব নিয়ে আমরা খুব একটা চিন্তিত নয়।

রাজধানী বা বিভাগীয় শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কিছুটা নজরদারির মধ্যে থাকলেও গ্রাম বা মফস্বশ শহরের শিক্ষা প্রতি¯¤ানগুলোতে সঠিক নজরদারি প্রায় হয় না বললেই চলে। আর এ সুযোগে এলাকার মাতবর শ্রেণীর অনেক লোকজনও ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডিতে ঢুকে পড়েন। এদের অনেকেরই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডিতে থাকার মতো কোনো যোগ্যতা নেই। যদিও দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার পর গেল বছর বেসরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির সভাপতি হওয়ার জন্য ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চমাধ্যমিক করা হয়। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে আমরা কতটা নজরদারি করতে পারছি! ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডির অন্য সদস্যদেরও ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজন রয়েছে বলেই মনে করি।  

কারণ অদক্ষ ও অযোগ্য সদস্যদের দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন সম্ভব নয়। এদের সবাই কি যথাযথ ভুমিকা রাখতে পারেন! অনেক শিক্ষিত ব্যক্তি যেমন ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডিতে থাকেন, তেমনি অনেক অশিক্ষিত ব্যক্তিকেও এসব পদে দেখা যায় প্রায়ই। গ্রাম বা মফস্বল শহরের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষিত ব্যক্তির পাশাপাশি অনেক অশিক্ষিত লোকজনকেও এসব কমিটিতে থাকতে দেখা যায়। প্রশ্নটা হচ্ছে যাদের নিজেদেরই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, তারা কীভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালাবেন! অনেক সময় অশিক্ষিত এ সদস্যরা শিক্ষকদের জন্যও বিব্রতকর হয়ে ওঠেন। একটি প্রান্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষক একদিন আফসোস করেই এক আলোচনায় বলেন, ‘ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডিতে মাঝে মাঝে এমন সদস্যও দেখা যায় যাদের সঙ্গে কথা বলারই রুচি হয় না।’

এ বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনার আরও সুযোগ আছে। কেবল সভাপতির ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করে দিলেই সমস্যার সমাধান মিলবে না। কমিটির সবারই ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলে সেটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্যই ভালো বলে মনে করি। অনেকে আবার ফোড়ন কেটে বলে থাকেন, শিক্ষিত লোকরাই দূর্নীতি বা অপকর্মে জড়ান। এটি দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। সব শিক্ষিত লোকই দূর্নীতি করেন বা অশিক্ষিত লোক বড় পদে গেলে দূর্নীতি করবেন না এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। মাথা ব্যাথার জন্য আমরা নিশ্চয়ই মাথা কেটে সমস্যার সমাধান করি না। শিক্ষার বিকল্প আসলে অন্য কিছু হতে পারে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ শিক্ষার আলো ছড়িয়ে সমাজের অন্ধকার দূর করা। যে প্রতিষ্ঠান শিক্ষার আলো ছড়াবে সে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সঙ্গে কোনো অক্ষরজ্ঞানহীন ব্যক্তি জড়িত থাকাটা সমিচীন বলে মনে করি না। এসব ক্ষেত্রে সবার জন্য ন্যুনতম শিক্ষার বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত। অর্থাৎ অভিভাবক প্রতিনিধি থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডিতে যারাই থাকবেন, তাদের সবারই ন্যুনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে। 

মফস্বল শহর এবং গ্রামাঞ্চলের প্রান্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকালে অনেক সময় চূড়ান্ত রকম হতাশ হতে হয়। দেখা যায় স্থানীয় ভাবে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে, অনেক সময় সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে অনেক অযোগ্য লোক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডিতে ঢুকে পড়েন। এদের না থাকে শিক্ষাগত যোগ্যতা, না থাকে অভিজ্ঞতা, না থাকে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ন্যূনতম দক্ষতা। শুধুমাত্র অর্থ কিংবা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কমিটিতে নিজেদের জায়গা করে নেন। তারা মনে করেন এতে তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু তাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনো উপকার যে হয় না তা বলাই বাহুল্য। এদের অনেকে শিক্ষা সংক্রান্ত অনেক বিষয় সম্পর্কে কোনো ধারণাই রাখেন না। আর এদের দৌরাÍে অনেক সময় সমাজের শিক্ষিত এবং প্রকৃত শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিরাও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কমিটিতে থাকার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। তাই প্রতিষ্ঠান ধরে ধরে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে অযোগ্য এবং অশিক্ষিত ব্যক্তিদের ম্যানেজিং বা গভর্নিং বডির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া উচিত। আর এক্ষেত্রে সরকার বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যে নিয়ম বা আইন আছে তার যথোপযুক্ত প্রয়োগ করতে হবে। যদি নিয়ম বা আইনে কোনো রকম ফাঁক-ফোকর থেকে থাকে তাও চিহ্নিত করে দ্রুত সংশোধন করতে হবে। যাতে কোনো ভাবেই ন্যুনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়া কোনো ব্যক্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং বা গভর্নিং বডির সদস্য হতে না পারেন।

আধুনিক বা উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটি দেশ এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় রকম ভুমিকা রাখে দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। শিক্ষার হার যত বাড়বে দেশ এগিয়ে যাবে তত। কিন্তু অযোগ্য, অশিক্ষিত ব্যক্তি বা নাগরিক দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিশেষ কোনো উন্নয়ন হতে পারে না। যারা এসব দায়িত্বে থাকবেন তাদের সবারই ন্যুনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। সম্রাট নেপোলিয়ন বলেছিলেন, আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও- আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিব। এই উপলব্ধি থেকেই অনুমান করা যায় শিক্ষার বিস্তারে শিক্ষিত এবং প্রকৃত শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি রাষ্ট্রের জন্য কতটা প্রয়োজন। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া একটি দেশ বা জাতিকে এগিয়ে নিতে একজন শিক্ষিত নাগরিকের কোনো বিকল্প থাকা উচিত নয়। মনে রাখতে হবে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সুশিক্ষায় শিক্ষিত জনগণই রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে পারে উন্নতির শিখরে। আসুন আমরা সম্মিলিতভাবে শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিই।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

AHA
আরও পড়ুন