শিশুদের ব্যবহৃত খেলনা ও অন্যান্য দৈনন্দিন ব্যবহৃত পণ্যে উচ্চ মাত্রায় সীসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। গবেষকরা বলছেন, এসব খেলনা ব্যবহারে শিশুদের সঠিক শারীরিক ও স্নায়ুবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়া কিডনি ড্যামেজ, হাড় মজবুত না হওয়া, শ্বাসকষ্ট, ত্বক জ্বালাপোড়া ও ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর) বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর সেন্টার অন ইন্টিগ্রেটেড রুরাল ডেভেলপমেন্ট ফর এশিয়া এন্ড দ্য প্যাসিফিকে আয়োজিত এক সেমিনারে এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন-এসডো গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী ২৫০টি পণ্যের মধ্যে ১৫৭ টি পণ্যের সীসা শনাক্ত হয়েছে। যার মধ্যে ৫৯% পণ্যে ৯০ পিপিএমের অধিক মাত্রার সীসা রয়েছে, যাতে ১৩৭০ পিপিএম মাত্রা পর্যন্ত সীসার উপস্থিতি পাওয়া যায়।
‘দ্য সাইলেন্ট পয়জন: ট্রেসেস অফ লেড ইন চাইল্ডহুড ট্রেজার্স’ শীর্ষক এই গবেষণা এসডোর ২০১৩ সালের গবেষণার ধারাবাহিকতা। যা শিশুদের খেলনায় সীসা, ক্যাডমিয়াম এবং থ্যালেটসের মতো ক্ষতিকর রাসায়নিকের উপস্থিতি প্রকাশ এবং এর মাধ্যমে শিশুদের সুরক্ষার বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করে।
২০২৩ সালে ফিলিপাইনের ব্যান টক্সিক্সা নামক বেসরকারী সংস্থার সাথে অংশীদারিত্বে আবারও বাংলাদেশে শিশুদের খেলনা পরীক্ষা করা হয়। পুনরায় ২০২৪ সালে ব্যান টক্সিক্স'-এর গবেষকগণ বাংলাদেশে এসে স্থানীয় বাজার থেকে সরাসরি শিশুদের পণ্য সংগ্রহ করেন এবং এক্স-রে ফ্লুরোসেন্স এক্সআরএফ মেশিন ব্যবহার করে সেগুলোতে সীসার মাত্রা বিশ্লেষণ করেন।
গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ ফলাফলসমূহ: শিশুদের খেলনায় উচ্চ মাত্রায় সীসা পাওয়া গেছে, যা ১.৬৮ পিপিএম থেকে ৩৭৯ পিপিএম পর্যন্ত বিস্তৃত। পরীক্ষিত ২৫০টি পণ্যের মধ্যে ১৫৭টি পণ্যেই সীসার উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে, যার মধ্যে ৯২টি পণ্যে সীসার পরিমাণ নিরাপদ সীমা ৯০ পিপিএমের চেয়ে বেশি।
একটি শিশুদের পানির মগে ১৩৮০ পিপিএম সীসা, ২৪৭ পিপিএম আর্সেনিক এবং ১৩৯০ পিপিএম ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে-প্রতিদিনের ব্যবহৃত একটি সাধারণ পণ্যে এই বিপজ্জনক রাসায়নিকের উপস্থিতি উদ্বেগজনক।
শিশুদের ব্যবহৃত স্টেশনারি ব্যাগে ৫৮০ পিপিএম সীসা, ১২৮০ পিপিএম বেরিয়াম, এবং ৮৮ পিপিএম পারদ পাওয়া গেছে-যা পড়াশোনার সরঞ্জামকেও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পরিণত করেছে। একটি পুতুল সেটে ১৬০ পিপিএম সীসা এবং ১৫০০ পিপিএম ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে-যা শিশুর প্রিয় খেলনাকেও বিপদজনক করেছে।
শিশুদের ব্যবহৃত একটি মগে ২২০ পিপিএম সীসা, ৩১৫ পিপিএম ক্যাডমিয়াম এবং ১৬৮০ পিপিএম ক্রোমিয়াম পাওয়াগেছে যা দৈনন্দিন ব্যবহারে শিশুকে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলছে। একটি নামকরা শপিংমল থেকে সংগ্রহ করা একটি পুতুল সেটেও ৫০০ পিপিএম সীসা পাওয়া গেছে, যা প্রমাণ করে যে উচ্চমানের পণ্যও সীসা থেকে মুক্ত নয়।
একটি বর্ণমালা সেটের একটি উজ্জ্বল বর্ণমালার অক্ষরে ৬৬০ পিপিএম সীসা পাওয়া গেছে-যা শিক্ষার পণ্যকেও ঝুঁকিতে ফেলেছে। বিভিন্ন দেশ, যেমন ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও অস্ট্রেলিয়ায় সীসার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশে এ নিয়ে এখনো কোন আইন নেই।
এসডোর চেয়ারপার্সন ও বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব সৈয়দ মারগুব মোর্শেদ বিষয়টির গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, শিশুদের পণ্যে সীসার উপস্থিতি একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষার জন্য আমাদের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
এসডোর মহাসচিব ড. শাহরিয়ার হোসেন খেলনার সুরক্ষা নিয়ে বলেন, খেলনা শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে সহায়ক, কিন্তু যখন তাতে সীসার মতো বিষাক্ত পদার্থ থাকে, তখন তা ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। এই খেলনাগুলি শিশুদের স্বাস্থ্য ও বিকাশের উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে। নিরাপদভাবে বেড়ে ওঠার পরিবেশ নিশ্চিত করতে খেলনাগুলি সীসামুক্ত হওয়া জরুরি।
এসডোর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দীকা সুলতানা শিশুদের স্বাস্থ্যের উপর সীসার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নিয়ে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, রক্তে সীসার কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই, যে কোনো পরিমাণে সীসা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। শিশুদের ক্ষেত্রে এটি আরও ভয়াবহ, কারণ তাদের শরীর দ্রুত সীসা শোষণ করে, যা মানসিক ও শারীরিক বিকাশে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এটি একটি স্বাস্থ্য সংকট, যার জন্য এখনই আইনি করা প্রয়োজন। এসডো ইতিমধ্যে বিএসটিআইয়ের সাথে এই বিষয়ে নীতিমালা তৈরিতে কাজ করছে।