ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

ব্যাটারিচালিত রিকশায় নাকাল ঢাকা

আপডেট : ১৭ আগস্ট ২০২৫, ০২:৪৪ পিএম

রাজধানী ঢাকার সড়ক-মহাসড়কগুলো এখন ব্যাটারিচালিত রিকশার দখলে। ঢাকাবাসীর অভিযোগ, ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকরা ট্রাফিক রুলস মানেন না। সড়কের যেখানে-সেখানে রিকশার ব্রেক কষেন। কোনো রকম সংকেত ছাড়াই দ্রুতগামী যানবাহনের সামনে দিয়েই নেন ইউটার্ন। ফলে পেছন থেকে আসা দ্রুতগামী গাড়ি এসে ব্যাটারিচালিত রিকশায় ধাক্কা দেয়। এতে ব্যাটারিচালিত রিকশা আকস্মিক গিয়ে পড়ে পথাচারীদের ওপর। ফলে প্রতিমুহূর্তেই দুর্ঘটনার শঙ্কা দেখা দিচ্ছে। বাড়ছে জনভোগান্তি। 

গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, রাজধানীর কুড়িল, বসুন্ধরা গেট, যমুনা ফিউচার পার্ক, নদ্দা, নতুনবাজার, বাঁশতলা, বাড্ডা, মধ্য বাড্ডা, রিং রোড, রামপুরা, মালিবাগ, মৌচাক, শান্তিনগর, মগবাজার, বিজয়নগর, নয়াপল্টন, পল্টন, প্রেস ক্লাব, মিরপুর, কালশী, মিরপুর মাজার রোডসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বেপারোয়া গতিতে চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। 

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে ৫ লাখের বেশি ব্যাটারিচালিত রিকশা চলে। আর প্যাডেলচালিত রিকশা রয়েছে ১০ লাখের বেশি। সূত্রটি বলছে, চলতি বছরের (২০২৫) মার্চে রাজধানীর ৩ পয়েন্টে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও প্যাডেলচালিত রিকশা বন্ধে ‘রিকশা ট্র্যাপার’ বসানো হয়। এই পয়েন্টগুলো হলো- কাকরাইল ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সের পাশে ব্যাটারি গলি; ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ১ নম্বর গেটের সামনে ও পুরোনো রমনা থানার সামনের সড়কে। আরও কিছু জায়গায় এই ট্র্যাপার বসানো হয়। তবে এই উদ্যোগ কোনো কাজে আসেনি। কারণ ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো এই ট্র্যাপার অনায়াসেই পার হয়ে যাচ্ছে। এতে প্রাইভেটকারের টায়ার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এয়ারপোর্ট থেকে বাড্ডা যাচ্ছেন আরিফ আহমেদ। তিনি বলেন, যমুনা ফিউচার পার্ক থেকে বাড্ডা যেতে সময় লাগার কথা ১০ মিনিট। অথচ এই ব্যাটারিচালিত রিকশগুলো সড়ক দখল করে রাখায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে সময় লেগে যাচ্ছে এক ঘণ্টারও বেশি। 

মালিবাগ এলাকার বাসিন্দা রফিক প্রামাণিক বলেন, দিনের গুরুত্বপূর্ণ সময় যানজটের কবলে নষ্ট হয়ে যায়। এই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে কবে যে রক্ষা পাবো! তিনি বলেন, মহাসড়কে অসংখ্য ব্যাটারিচালিত রিকশা চলার কারণে যাত্রীবাহী বাসগুলো সহজে চলাচল করতে পারে না।

সুকান্ত বিশ্বাস বলেন, প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় ও অফিস সময় এসব এলাকায় কয়েক ঘণ্টা তীব্র যানজট লেগেই থাকে। জরুরি প্রয়োজনে গাড়ি বের করলেও সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছানো দায় হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে যমুনা ফিউচার পার্ক, বাড্ডা, রামপুরা ও মালিবাগে যানজট যেন নিত্যদিনের সঙ্গী।

প্রাইভেটকার চালক মনির হোসেন বলেন,  প্রাইভেটকার চালানো অনেক কষ্ট। যানজটে নষ্ট হয় অধিকাংশ সময়। ব্যাটারিচালিত রিকশার দৌরাত্ম্যে স্বাভাবিক চলাচল করতে পারি না। কারণ এই রিকশাচালকরা মহাসড়কের নিয়ম-কানুন না জেনে, না মেনেই চলাচল করেন। এতে মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে প্রতিদিন। 

যাত্রীবাহী বাস ভিক্টরের চালক রাজ্জাক বলেন, আমরা মহাবিপদে। কারণ গাড়িতে যাত্রী না থাকলে আয় থাকে না। এদিকে ব্যাটারিচালিত রিকশার বেপরোয়া গতির কারণে যাত্রীরা নিরাপদে রাস্তা পার হয়ে বাসে উঠতে পারেন না। বাসে উঠলেও ৩০ মিনিটের রাস্তায় ২ ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। ব্যাটারিচালিত রিকশার দখলে থাকা সড়কে স্বাভাবিক গতিতে বাস চালানো যায় না। ফলে যাত্রীদের অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে। তারা গণপরিবহন বিমুখ হচ্ছেন। আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।

মোটরসাইকেল চালক আব্বাস শেখ বলেন, সময় বাঁচানোর জন্য মোটরসাইকেল নিয়ে চলাচল করতে হয়। এরপরও দেখা যায়, বেপরোয়া গতির ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে যানজটে পড়তে হয়। 

বাড্ডা এলাকার রিকশাচালক সালাউদ্দিন মণ্ডল বলেন, প্রয়োজনের তাগিদে ৩ বছর আগে ঢাকায় এসেছি। কোনো কাজ না পেয়ে রিকশা চালাতে হচ্ছে। কিন্তু রিকশা আমরা কোথায় চালাবো? 

রামপুরা এলাকায় রিকশা চালান লাল্টু মীর। তিনি বলেন, ১০-১২ বছর যাবৎ ঢাকায় এসেছি। এখন আমি ও আমার দুই ছেলে রিকশা চালাই। সংসার চালাতে রিকশা চালানোর বিকল্প নেই। কেউ ইচ্ছা করে রিকশা চালায় না। পেট চালানোর তাগিদে রিকশা চালাতে হয়। কিন্তু মাঝেমধ্যে রিকশাচালকদের ওপর নির্যাতন চলে। রাস্তায় যানজট হলে রিকশাচালকের দোষ। দেখা যায়, মহাসড়কে প্রাইভেট কার দিন দিন বাড়ছে। বিত্তশালী পরিবারের প্রত্যেক সদস্য একটি করে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। রাস্তার পাশে পার্কিং করে রাখছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সেটা কেউ দেখে না। শুধু দেখে আমাদের।

বনশ্রীর সি-ব্লক ও ডি-ব্লকের মাঝখানের অ্যাভিউনিউয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালান ইদ্রিস আলী। তিনি দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে আসছিলেন। ৩ নম্বর রোডের কাছাকাছি এসেই হঠাৎ ইউটার্ন নিলেন দক্ষিণ দিকে, কিন্তু কোনো সিগন্যাল দিলেন না। সিগন্যাল ছাড়াই এভাবে টার্ন নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বামে কোনো গাড়ি বা মানুষ নেই। তাই কোনো সিগন্যাল না দিয়েই চলে এসেছি। যদি কেউ থাকতো, তাহলে দুর্ঘটনা ঘটতো কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘স্যার আমার ভুল হয়েছে। আমার উচিত ছিল, দেখে টার্ন নেওয়া।’ 

বিটিভির উত্তরপাশের প্রধান সড়ক থেকে পথচারীদের গা ঘেঁষে বনশ্রীর দিকে বেপরোয়া গতিতে যাচ্ছিলেন কবির হোসেন। এভাবে বেপরোয়া গতিতে চালানোর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা এভাবেই আসি। কখনো কোনো সমস্যা হয় না।’ 

এক প্রশ্নের উত্তরে লাল চাঁদ নামের আরেক চালক বলেন, ‘আমি ঢাকায় ৩-৪ মাস আগে এসেছি। যে কারণে অনেক নিয়ম জানি না।’

মগবাজার এলাকায় চা ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম বলেন, আগে রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতাম। কিন্তু বয়স হওয়ায় এখন আর রিকশা চালাতে পারি না। বাধ্য হয়ে এখানে একটি চায়ের দোকান দিয়েছি।

মগবাজার এলাকায় রিকশা-ভ্যান মিস্ত্রি জাকির হোসেন বলেন, ভাই অভাবের তাড়নায় কত কিছু করে খেতে হয়। বয়স বাড়ছে, দুই বছর যাবৎ এই এলাকায় রিকশা-মেরামত করে ৫ জনের সংসার চালাই।

পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, এই দায় আমরা কেউ এড়াতে পারি না। রাজধানীর সড়ক-মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশার অনুপ্রবেশ বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে বিকল্প সড়ক, ফিডার রোড ও সময়সূচি প্রণয়ন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ না হলে রাজধানীর সড়ক-মহাসড়কে নৈরাজ্যের অবসান হবে না।
 
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্দিষ্ট লেন না থাকায় ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলার অভাবে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। আইন থাকলেও তার প্রয়োগ সীমিত। এছাড়া নগর পরিকল্পনায় রিকশার জন্য বিকল্প রুট না থাকার কারণেও সমস্যা জটিল আকার ধারণ করেছে।

ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের মাঠ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ রাখতে শুধু ট্রাফিক বিভাগ নয়, সংশ্লিষ্ট সব বিভাগকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, না হলে ঢাকার রাস্তায় ট্রাফিক ব্যবস্থার অবনতি দিন দিন বাড়বে।

সড়ক-মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে দুর্ভোগ হওয়ার কথা স্বীকার করে অ্যাডিশনাল ডিআইজি (ট্রাফিক) ঢাকা, মোহাম্মদ সুলাইমান দৈনিক খবর সংযোগকে বলেন, রিকশা-অটোরিকশার জন্য মাঝেমধ্যে অভিযান চালালেও আবারও সড়কে নেমে পড়েন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা।

NJ
আরও পড়ুন