বিভিন্ন রাজ্যে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর চাপে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের এখন নতজানু অবস্থা। এরই মধ্যে কয়েকটি জায়গায় বিদ্রোহীদের কাছে নতি স্বীকার করে পালাতে হয়েছে দেশটির সেনাদের। রাখাইন রাজ্যেও তাদের পলায়নপর অবস্থা। সেনারা দায়িত্ব ছেড়ে পালাচ্ছে। এমন অবস্থায় সেনাবাহিনীর পাল্লা ভারী করতে দেশটিতে রোহিঙ্গাদের লোভনীয় প্রস্তাব দিয়েছে জান্তা সরকার।
প্রস্তাবে রাখাইন প্রদেশের বিভিন্ন গ্রাম ও উদ্বাস্তু শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের চলাফেরায় স্বাধীনতা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে সেনাবাহিনীতে নেওয়ার চেষ্টা করছে দেশটির সরকার। আশঙ্কা করা হচ্ছে, মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধে রোহিঙ্গাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে।
দ্য ইরাবতীর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি রাখাইন প্রদেশের রাজধানী সিত্তে ও বুথিডং শহরের কিছু উদ্বাস্তু শিবির ও আশেপাশের গ্রাম থেকে অন্তত ৪০০ রোহিঙ্গাকে দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণের জন্য সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ঘাঁটিতে পাঠানো হয়েছে। প্রদেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য তাদেরকে জোরপূর্ক ও লোভ দেখিয়ে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
জান্তা বাহিনী রোহিঙ্গা পুরুষদের বলছে, তারা সেনাবাহিনীতে চাকরি করলে প্রত্যেককে এক বস্তা করে চাল ও নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র দেওয়া হবে। পাশাপাশি মাসিক ১ লাখ ৫০ হাজার কিয়াট তথা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭ হাজার ৮৪০ টাকা করে বেতন দেওয়া হবে।
চলমান পরিস্থিতিতে জান্তা সরকার মিয়ানমারের তরুণদের বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে যোগদানের একটি আইন কার্যকর করেছে। গত ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে ওই আইন কার্যকর করার পর দেশজুড়ে তরুণদের সেনাবাহিনীতে যোগদানে বাধ্য করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবেই রোহিঙ্গাদেরও সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। অথচ জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবেই স্বীকার করে না। তবে এবার যুদ্ধে যোগ দেওয়ার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার লোভ দেখানো হচ্ছে।
ওই আইনে বলা হয়েছে, ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী পুরুষ ও ১৮ থেকে ২৭ বছর বয়সী নারীদের অবশ্যই দুই বছরের জন্য সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হবে। আইনটি কার্যকর করার পর থেকে মিয়ানমারের শহরগুলো থেকে তরুণরা পালিয়ে যেতে শুরু করেছে। তরুণরা বলেছে, তারা দেশ ছেড়ে চলে যাবে বা জান্তাবিরোধী বাহিনীগুলোতে যোগ দেবে। তবু অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করা সামরিক বাহিনীর জন্য লড়াই করবে না।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, জান্তা সরকার রাখাইন রাজ্যে জাতিগত উত্তেজনা ছড়াতে রোহিঙ্গাদের সামরিক চাকরিতে নিয়োগ করছে। আর আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের নিয়োগ বেআইনি হবে। কারণ জান্তা সরকার গত কয়েক দশক ধরে রোহিঙ্গাদের দেশটির নাগরিকত্ব দেয়নি।
২০১৭ সাল থেকে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে বসবাস করছে। সে বছর মিয়ানমারের জান্তা সরকার রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা ও জাতিগত নিধন শুরু করলে তারা প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
এ ছাড়া মিয়ানমারেও অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত আরও ৬ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এদের বেশির ভাগই জাতিসংঘের শরণার্থী শিবিরগুলোতে বাস করে এবং স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে না। রাখাইনের রাজধানী সিত্তে শহরের ১৩টি ক্যাস্পে বাস করে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা। ২০১২ সালে জাতিগত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তারা ঘরবাড়ি হারা হয়।
তবে ক্যাম্পের কয়েকজন বাসিন্দা বলেছেন, তারা মরে গেলেও জান্তা বাহিনীতে চাকরি করবেন না। তাদের মতে, রোহিঙ্গা মুসলমান ও রাখাইন বৌদ্ধদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্যই সেনাবাহিনী এই কৌশল নিয়েছে। কিন্তু জান্তা বাহিনী উদ্বাস্তু শিবিরগুলো ঘিরে রাখায় রোহিঙ্গারা পালাতেও পারছে না।
