পৃথিবীর সমুদ্রের তলদেশে ছড়িয়ে থাকা রঙিন প্রবালপ্রাচীরগুলো শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতীক নয়; বরং এগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুসংস্থানের (ecosystem) অংশ। বিজ্ঞানীরা প্রবালপ্রাচীরকে ‘সমুদ্রের রেইনফরেস্ট’ বলে থাকেন। কারণ এতে পৃথিবীর প্রায় ২৫ শতাংশ সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য বিদ্যমান। কিন্তু ক্রমবর্ধমান দূষণ, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও অশোভন মানবিক কার্যকলাপের কারণে যদি একদিন পৃথিবীর সব প্রবালপ্রাচীর ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে এর প্রভাব কেবল সমুদ্র নয়, সমগ্র পৃথিবীকে নাড়িয়ে দেবে।
প্রবালপ্রাচীরগুলো বহু প্রজাতির প্রাণীর আবাস, প্রজননক্ষেত্র ও খাদ্যের উৎস। এগুলো ছাড়া সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থান কার্যত অচল হয়ে যাবে। ছোট মাছ থেকে বড় শিকারি মাছ, শামুক, ঝিনুক, কাঁকড়া— সবাই কোনো না কোনোভাবে প্রবালের ওপর নির্ভরশীল। প্রবালপ্রাচীর ধ্বংস হলে লাখ লাখ প্রজাতি তাদের আশ্রয় হারাবে, যা ব্যাপক হারে জীববৈচিত্র্য হ্রাস ঘটাবে। ফলে অনেক প্রজাতি চিরতরে হারিয়ে যাবে, যার প্রভাব খাদ্যশৃঙ্খল থেকে শুরু করে সামুদ্রিক আচরণ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে।
প্রবালপ্রাচীর প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করে, যা প্রবল ঢেউ, ঝড় ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব কমায়। প্রাচীরগুলো না থাকলে উপকূলীয় অঞ্চলগুলো ঢেউয়ের সরাসরি আঘাতে বিধ্বস্ত হবে। বিশেষত নিচু দেশ ও দ্বীপরাষ্ট্রগুলো— যেমন মালদ্বীপ, কিরিবাতি, ট্যুভালু— চরম ঝুঁকিতে পড়বে, যেখানে জনপদ, অবকাঠামো এবং কৃষি জমি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।
প্রবালপ্রাচীরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা। প্রবালপ্রাচীর মৎস্যসম্পদের বড় উৎস, যা স্থানীয় এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। উদাহরণ হিসেবে অস্ট্রেলিয়া বা কোরিয়ার মতো দেশের সমুদ্র অর্থনীতি উল্লেখযোগ্য। প্রাচীর ধ্বংস হলে মৎস্যশিল্পে ধস নামবে, যার ফলাফল হবে ব্যাপক বেকারত্ব, খাদ্যসংকট ও আর্থিক ক্ষতি। উন্নয়নশীল দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যারা সামুদ্রিক সম্পদের ওপর নির্ভর করে থাকে।
প্রবাল ক্যালসিয়াম কার্বনেট দিয়ে তৈরি হয়, যা সমুদ্র থেকে কার্বন ডাই–অক্সাইড শোষণ করে গঠিত হয়। এই প্রাকৃতিক শোষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হলে বাতাসে কার্বন ডাই–অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করবে। সমুদ্রের রাসায়নিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হবে, লবণাক্ততা ও অম্লতা (acidity) বাড়বে, যা অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর জন্যও হুমকির কারণ হবে।
পরিস্থিতি এখনও রক্ষার মধ্যে রয়েছে। বিজ্ঞানীরা ও পরিবেশবিদরা বলছেন— প্রবালপ্রাচীর রক্ষায় এখনই বৈশ্বিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এটি করতে হবে দূষণ নিয়ন্ত্রণ, কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, সমুদ্রের উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণ এবং টেকসই মৎস্যচাষের মাধ্যমে। পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সচেতনতা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
প্রবালপ্রাচীরের ধ্বংস শুধু সামুদ্রিক জীবনের জন্য নয়, বরং মানবসভ্যতার জন্যও এক চরম বিপর্যয় বয়ে আনবে। এটি শুধু প্রাকৃতিক রূপের ক্ষতি নয়, বরং পরিবেশ, অর্থনীতি, খাদ্যনিরাপত্তা ও মানবজীবনের অস্তিত্বের হুমকি। এখনই আমাদের সময় সচেতন হয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই রঙিন, সমৃদ্ধ বাস্তুসংস্থান রক্ষা করা যায়।