ঢাকা
সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

সয়াবিন তেল সিন্ডিকেটেই বন্দি

‘পুরো বাজার ব্যবস্থাপনা সিন্ডিকেটের দখলে। এখানে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে উপদেষ্টাদের কোনো বক্তব্য নেই। বাজারে সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না।’ 

আপডেট : ০৩ জুন ২০২৫, ০১:৫৩ পিএম

মাস দু’য়েক আগে একবার ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট তৈরি করলে এক দফা দাম বাড়ে সয়াবিন তেলের। সরকার শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ করার পরেও বাড়ানো হয় দাম। এর মাসখানেক যেতে না যেতেই ফের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা শুরু হয়েছে। আর এক দিন পরেই রমজান। এ উপলক্ষে সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোর পাঁয়তরা চলছে। তবে অভিযোগের বিষয়ে জানতে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো ধরনের যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

দেশের নিত্যপন্যের বাজারের অস্থিরতা কোনভাবেই থামছে না। এবার আগুন জ্বলছে ভোজ্য তেলে। বিদেশ থেকে সয়াবিন তেল আমদানি করার ক্ষেত্রে সরকার শুল্ক কমিয়েও গ্রাহক পর্যায়ে তার সুফল দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। আগের দিনের সরিষার তেলের বিকল্প হিসেবে সয়াবিনের বাড় বাড়ন্ত’র সুযোগ নিচ্ছে এই সিন্ডিকেট। তাই দেশের ভোজ্যতেলের বাজারে আসছে না স্বস্তি। 

এবারও বাজারে কৃত্রিম সরবরাহ সংকট তৈরি করে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশিতে বিক্রি করা হচ্ছে সয়াবিন তেল। আবার সেই তেল কিনতে সঙ্গে নির্ধারিত অন্য পণ্যও নেওয়া করা হয়েছে বাধ্যতামূলক। এমনটিই জানালেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আর ক্রেতারা। 

এ বিষয়ে বাজারে যারা অহেতুক দাম বাড়ায়, তাদের ছাড় দেয়া হবে না বলে মন্তব্য করেছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। তিনি বলেন, ‘বাজারে যারা অহেতুকভাবে অন্যায়ভাবে খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ায়, তাদের ছাড় দেয়া হবে না।’ 

শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর মেরুল বাড্ডা এলাকার সিরাজ মিয়া মেমোরিয়াল মডেল স্কুল প্রাঙ্গণে ‘রমজানে সুলভমূল্যে দুধ, ডিম ও মাংস’ বিক্রয় কার্যক্রম উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা স্বাধীন দেশে নতুন করে পবিত্র রমজান পালন করবো। সেই ক্ষেত্রে আমাদের দায়িত্ব অনেক বেশি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে শুধু কিছু সংস্কার করবো তা নয়, আমাদের কাজ হচ্ছে সাধারণ মানুষ যেসব কারণে কষ্ট পাচ্ছিল, বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি কমিয়ে আনা। এখন দ্রব্যমূল্য পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। সে জন্য আমরা চেষ্টা করছি রমজান মাসকে কেন্দ্রে করে হলেও অতি প্রয়োজনীয় কিছু পণ্য সাশ্রয় মূল্যে বিক্রি করতে।’

রাজধানীর ২৫টি স্থানে প্রথম রমজান থেকে ২৮ রমজান পর্যন্ত সুলভ মূল্যে প্রাণিজাত পণ্য বিক্রয় করা হবে।  সুলভ মূল্যে প্রাণিজাত পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে জুলাই বিপ্লবের সময় যে সকল স্থানে সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহন বেশি ছিল সেসকল স্থানকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে এবং বস্তি এলাকায় বিক্রির ব্যবস্থা করা হবে। 

এলাকাগুলো হচ্ছে- সচিবালয়ের পাশে (আব্দুল গণি রোড), খামারবাড়ী (ফার্মগেট), ষাটফুট রোড (মিরপুর), আজিমপুর মাতৃসদন (আজিমপুর), নয়াবাজার (পুরান ঢাকা), বনশ্রী, হাজারীবাগ (সেকশন), আরামবাগ (মতিঝিল), মোহাম্মদপুর (বাবর রোড),  কালশী (মিরপুর), যাত্রাবাড়ী (মানিক নগর গলির মুখে), শাহাজাদপুর (বাড্ডা), কড়াইল বস্তি- বনানী, কামরাঙ্গীর চর, খিলগাঁও (রেল ক্রসিং দক্ষিণে), নাখাল পাড়া (লুকাস মোড়),  সেগুন বাগিচা (কাঁচা বাজার), বসিলা (মোহাম্মদপুর), উত্তরা (হাউজ বিল্ডিং), রামপুরা (বাজার), মিরপুর ১০, কল্যাণপুর (ঝিলপাড়), তেজগাঁও, পুরান ঢাকা (বঙ্গবাজার) ও কাকরাইল।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জানানো হয়, সুলভমূল্যে বিক্রয় কার্যক্রমে ড্রেসড ব্রয়লার মাংস (প্রতি কেজি) ২৫০ টাকা, দুধ পাস্তুরিত (প্রতি লিটার) ৮০ টাকা, ডিম (প্রতি ডজন) ১১৪ টাকা এবং গরুর মাংস (প্রতি কেজি) ৬৫০ টাকা মূল্যে বিক্রয় করা হবে। এতে সহযোগিতা করছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রাণিসম্পদ ও ডেইরী উন্নয়ন প্রকল্প (এলডিডিপি), বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্ন্সিল (বিপিআইসিসি), বাংলাদেশ ডেইরি এন্ড ফ্যাটেনিং ফারমার্স এসোসিয়েশন (বিডিএফএফএ) এবং দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য অংশীজন এবং প্রান্তিক খামারিগণ।

এদিকে রাজধানীর কয়েকটি বাজার সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করা হচ্ছে। তাই খোলা তেলও বিক্রি হচ্ছে বেশি দামে। খন্দকার এন্টারপ্রাইজের কর্মচারী মো. রাসেল বলেন, সয়াবিন তেল বাজারে নেই। আমাদের ৫ লিটারের চার বোতল সয়াবিন তেলের একটি কার্টনের সঙ্গে ডিলার ১০ কেজি চিনিগুঁড়া চাল  নিতে বাধ্য করেছেন।  এই চাল না নিয়ে সয়াবিন তেল দেওয়া যাবে না বলে তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। আমাদের নিয়মিত খরিদ্দারদের কারণে আমরা তাদের শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছি। আবার আমরাও ক্রেতাদের কাছে একই শর্তে সয়াবিন তেল বিক্রি করছি।
 
মো. রাসেল জানান,  ‘৫ লিটার সয়াবিন তেল ও এক কেজি চিনিগুঁড়া চালসহ এক হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ৮৫০ টাকা তেলের দাম, ১৫০ টাকা চালের দাম। প্রায় সব কোম্পানিই ডিলারদের শর্ত দিয়েছে, তেলের সঙ্গে স্লো আইটেম নিতে হবে। কোম্পানিভেদে প্রত্যেকের অন্য প্রোডাক্ট চাল, চা-পাতা, সরিষার তেল, মুড়ি, পানি রয়েছে। তাদের কাছ থেকে তেল নিতে হলে এসব স্লো আইটেম নিতে হচ্ছে। ৫ লিটার তেল কোম্পানির ডিলার থেকে আমরা ৮৪২ টাকায় কিনি, ৮৫০ টাকায় বিক্রি করি। সঙ্গে বাধ্য হয়েই এক কেজি চিনিগুঁড়া চাল ১৫০ টাকা মিলে এক হাজার টাকায় তেল ও চাল বিক্রি করছি।’

অপরদিকে সয়াবিন তেল দোকানে না রেখে গুদামে মজুদ রাখার অভিযোগে চট্টগ্রামে দুই প্রতিষ্ঠানকে ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজারে এ অভিযান পরিচালনা করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। অভিযানে সিদ্দিক আহমেদ চৌধুরী স্টোরকে ৫০ হাজার টাকা ও মোমিন রোডে অবস্থিত মেসার্স শরীফ স্টোরকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

ভোজ্যতেল বাদেও এসব করপোরেট প্রতিষ্ঠানের রয়েছে চাল, ডালসহ বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা। বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার খোলাবাজারে ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করে দিলেও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তেলের সঙ্গে অন্য ভোগ্যপণ্য বিক্রির কৌশলে প্রতিনিয়ত ঠকছেন ভোক্তারা। বর্তমানে বাজারে শিল্প গ্রুপ সিটি গ্রুপের ‘তীর’, মেঘনা গ্রুপের ‘ফ্রেশ’, টিকে গ্রুপের ‘পুষ্টি’, আবুল খায়ের গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান স্মাইল ফুড প্রোডাক্টসের ‘স্টারশিপ’, বসুন্ধরা গ্রুপের ‘বসুন্ধরা’ এবং বাংলাদেশ এডিবল অয়েল কোম্পানির ‘রূপচাঁদা’ ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল রয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার চার মাস পর গত  ৯ ডিসেম্বর সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ৮ টাকা বাড়ানো হয়। ওইদিন ঢাকার সচিবালয়ে ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকের পর বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন সয়াবিন তেল ও পাম তেলের নতুন দাম ঘোষণা করেন। পরদিন ১০ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয় ওই দাম। প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৮ টাকা বাড়িয়ে ১৭৫ টাকা, খোলা সয়াবিন ১৪৯ থেকে বাড়িয়ে ১৫৭ টাকা। খোলা পাম তেলের দাম লিটারে ১৪৯ থেকে বাড়িয়ে ১৫৭ টাকা করা হয়। 

এছাড়া বোতলজাত পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয় ৮৬০ টাকা, যা আগে ছিল ৮১৮ টাকা। নগরীর কাজীর দেউড়ি এলাকার মুদি দোকানগুলোতে পণ্য সরবরাহ করেন রূপচাঁদা ব্র্যান্ডের ডিলার মেসার্স জায়ান এন্টারপ্রাইজ। জায়ান এন্টারপ্রাইজের হয়ে বিপণনে কাজ করেন বাংলাদেশ এডিবল অয়েল কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি (এসআর) মো. ফিরোজ। 

জানতে চাইলে মো. ফিরোজ বলেন, ‘খুচরা দোকানিরা যেভাবে বলছেন, বিষয়টি তেমন নয়। মূলত আমাদের সয়াবিন তেল বাদেও আরও আট-দশটি প্রোডাক্ট রয়েছে। আমরা দোকানে স্লিপ কাটতে গেলে দোকান দারদের অন্য প্রোডাক্টগুলো নেওয়ার অনুরোধ করি, কিন্তু বাধ্য করা হয় না।’ 

কাস্টমস ও বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি মাসেই অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি হয়েছে প্রায় চার লাখ টন। এর মধ্যে ৬০ হাজার টন অপরিশোধিত সয়াবিন নিয়ে আসা ‘এমভি সুবরা’ জাহাজাটি খালাস শেষে ২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দর ত্যাগ করেছে। তাছাড়া ব্রাজিল, আমেরিকা, কানাডা, আর্জেন্টিনা থেকে পাঁচটি জাহাজে আসা ২ লাখ ৬০ হাজার টন অপরিশোধিত ভোজ্যতেল খালাস হচ্ছে।

এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘পুরো বাজার ব্যবস্থাপনা সিন্ডিকেটের দখলে। এখানে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে উপদেষ্টাদের কোনো বক্তব্য নেই। বাজারে সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ লাখ লাখ টন সয়াবিল তেল আমদানি হয়েছে। মিলারদের গোডাউনে সয়াবিন তেল রয়েছে। তারা সিন্ডিকেট করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে রেখেছে।’ 

MN