ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

জেট ফুয়েলের বাজার কাদের নিয়ন্ত্রণে

আপডেট : ২৭ জুন ২০২৫, ০২:৫৪ এএম

আকাশপথে চলাচলের আধুনিক যুগে প্রতিদিন অসংখ্য উড়োজাহাজ ছুটছে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। চোখ ধাঁধানো এই যান্ত্রিক বিস্ময়ের পেছনে লুকিয়ে আছে এক অদৃশ্য নায়ক- ‘জেট ফুয়েল’। এটা কোনো সাধারণ পেট্রোল বা ডিজেল নয়, বরং অত্যন্ত পরিশোধিত, শক্তিশালী ও উচ্চমানের এক বিশেষ জ্বালানি, যা উড়োজাহাজকে আকাশে ওড়ার ক্ষমতা দেয়। কিন্তু কীভাবে তৈরি হয় এই জ্বালানি? কোন কোন দেশ নিয়ন্ত্রণ করে এর উৎপাদন ও বাজার? পরিবেশের ওপর এর প্রভাবই বা কেমন?

উড়োজাহাজ আকাশে ওড়ার জন্য যে শক্তি ব্যবহার করে, সেটি মোটেই সাধারণ ডিজেল বা পেট্রোল নয়। এটি এক ধরনের বিশেষভাবে পরিশোধিত জ্বালানি, যার নাম জেট ফুয়েল বা এভিয়েশন টারবাইন ফুয়েল (এটিএফ)। আকাশপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি আজ বিশ্বজুড়ে জ্বালানি নিরাপত্তা ও পরিবেশ ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে।

বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন প্রায় এক লাখেরও বেশি বাণিজ্যিক ফ্লাইট চলাচল করে। এই বিশাল সংখ্যক ফ্লাইট পরিচালনার পেছনে রয়েছে জেট ফুয়েলের চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থার একটি জটিল কাঠামো। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী দশকে বিমান জ্বালানির চাহিদা ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।

কী এই জেট ফুয়েল?

জেট ফুয়েল হচ্ছে এক ধরনের তরল হাইড্রোকার্বন যা মূলত পেট্রোলিয়াম থেকে তৈরি। এটি অত্যন্ত উচ্চমাত্রায় পরিশোধিত এবং খুব ঠান্ডা পরিবেশেও তরল থাকতে সক্ষম, যা উড়োজাহাজের জন্য অপরিহার্য।

বিশ্বব্যাপী দু’ধরনের জেট ফুয়েল সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়

জেট এ-১ (Jet A-1) আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে বেশি ব্যবহৃত হয়।
জেট এ (Jet A) মূলত যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে ব্যবহৃত হয়।
আরও পড়ুন: বিশ্ববাজারে আবারও বাড়লো স্বর্ণের দাম

ছোট বিমানের জন্য ব্যবহৃত হয় অ্যাভগাস (বিমান পরিবহনের গ্যাসোলিন), যা মূলত প্রপেলারচালিত বিমান বা প্রশিক্ষণ বিমানে ব্যবহৃত হয়।

কোথায় হয় উৎপাদন?

বিশ্বের বহু দেশ জেট ফুয়েল উৎপাদন করে থাকলেও এর মধ্যে কয়েকটি দেশ নেতৃত্বে রয়েছে:

যুক্তরাষ্ট্র: জেট ফুয়েল উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষে। তাদের দৈনিক উৎপাদন প্রায় ১৫ লাখ ব্যারেল।
চীন: ব্যাপক অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট ও সামরিক চাহিদা পূরণে চীন বড় উৎপাদক ও ভোক্তা।
সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত: বিশাল তেল মজুদ ও পরিশোধনাগারের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
ভারত: নিজস্ব চাহিদার বড় অংশ মেটানোর পাশাপাশি কিছু জেট ফুয়েল রপ্তানিও করে থাকে।
রাশিয়া: জ্বালানি রপ্তানিতে অন্যতম প্রধান দেশ, জেট ফুয়েলকেও রপ্তানির তালিকায় রেখেছে।
একটি ব্যারেল অপরিশোধিত তেল (১৫৯ লিটার) থেকে প্রায় ৮-১০ শতাংশ জেট ফুয়েল পাওয়া যায়। তবে এটি নির্ভর করে কোন ধরনের তেল এবং কীভাবে পরিশোধন করা হচ্ছে তার ওপর।

পরিবেশ ভাবনা ও বিকল্প উদ্যোগ

জেট ফুয়েল পরিবেশের জন্য একধরনের চ্যালেঞ্জও বটে। এটি পোড়ালে প্রচুর পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। এ কারণে এখন গবেষণা চলছে টেকসই বিমান জ্বালানি (এসএএফ) Sustainable Aviation Fuel (SAF) নিয়ে, যা উদ্ভিজ্জ তেল, ব্যবহৃত রান্নার তেল কিংবা বর্জ্য থেকে উৎপাদিত হয়।

ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এমন বহু দেশ ইতিমধ্যে এসএএফ ব্যবহার শুরু করেছে সীমিত পরিসরে। তবে এটি এখনো প্রচলিত জেট ফুয়েলের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ দামে বিক্রি হয়।

বিমানের জ্বালানি কোথায় থাকে?

বিমানের জ্বালানি ডানায় থাকার বেশি কিছু কারণ আছে। উড়োজাহাজের দুইটি ডানায় দুইটি ট্যাংক রাখার ফলে এটি চমৎকার ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে। বিমানের জ্বালানির ওজন বিমানের মোট জিনিসপত্রের ওজনের এক তৃতীয়াংশ। 

বিমানের জ্বালানি ডানায় থাকার কারণ

এই পরিমান ওজনের তেল বিমানের ফিউজলেজ বা  বেলুনাকার শরীরে রাখলে  বিমানের মালপত্র রাখার স্পেস কমে যাবে। বিমানের স্ট্রাকচারের ওপর অনেক বেশি চাপ পড়বে। তাই ডানায় তেল ভরে তার  ওজনটাকে সুষমভাবে ছড়িয়ে দিয়ে এই সমস্যা অনেকটাই কম করা হয়।

বিমানের ডানার ফুয়েল ট্যাংকে জ্বালানি থাকার ফলে ডানার  নি থাকা ইঞ্জিনে  তেল পৌঁছাতে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সাহায্য মেলে। একে বলে গ্রাভিটি ফিডিং।

ডানার ভেতরে তেল রাখলে উইং যান্ত্রিকভাবে শক্ত সমর্থ  হয় ফলে ওড়ার সময় যে স্ট্রেস ও স্ট্রেন তৈরি হয় তাকে মোকাবিলা করা বিমানের  পক্ষে সহজ হয়।

বিমানের ডানার তেল ভরা থাকার ফলে উড়ানের সময় এবং টেক অব  ল্যান্ডিংয়ের উইং ফ্লাটার অনেক কম হয়।  উইং ফ্লাটার হল বিমানের পাখার কম্পন বা ভাইব্রেশন।

উড়জাহাজের মাইলেজ কেমন?

এবার জানা যাক, ১ লিটার এভিয়েশন ফুয়েলে বিমান কতটা মাইলেজ দেয়। আসলে, ফ্লাইট এর মাইলেজ গাড়ি কিংবা বাইকের মত গণনা করা হয় না। রিপোর্ট অনুযায়ী, ফ্লাইট এর স্থল গতি প্রতি ঘন্টায় ৯০০ কিলোমিটার অর্থাৎ ২৫০ মিটার প্রতি সেকেন্ড। এই এক ঘন্টায় ২৪০০ লিটার জ্বালানি খরচ হয় এবং ৯০০ কিলোমিটার ফ্লাইট উড়ে যায়। এই ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটারে ২.৬ লিটার জ্বালানি এবং প্রতি ৩৮৪ মিটারে এক লিটার জ্বালানি খরচ হয়।

জেট ফুয়েল শুধু একটি জ্বালানি নয়, বরং এটি একটি কৌশলগত সম্পদ। বিশ্বব্যাপী আকাশপথের বিস্তার, সামরিক প্রয়োজনে প্রস্তুতি এবং বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় এই জ্বালানির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও বিকল্প জ্বালানির মাধ্যমে বিমান খাতকে আরও টেকসই করে তোলার চেষ্টা চলছে, তবে এখনও পর্যন্ত আকাশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ঐ বিশেষ জ্বালানি জেট ফুয়েল। তথ্য সূত্র: ফিনান্সিয়াল টাইমস, রয়টার্স

khk
আরও পড়ুন