কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে অজানা রোগ। ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়া রোগটিকে নেটিজেনরা বলছেন অজানা ভাইরাস। স্থানীয় গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষের ভাষায় ‘লুলা ব্যারাম’। তবে লক্ষণগুলো মিলে যাচ্ছে অনেকটা এডিস মশাবাহিত চিকনগুনিয়ার সাথে। এ রোগের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন ডাক্তাররা। হাসপাতাল ও ফার্মেসিগুলোতে ভীড় লেগেই আছে।
কিন্ত মাসাধিককাল ধরে এ রোগ ছড়াতে থাকলেও স্বাস্থ্য বিভাগ এ পর্যন্ত জনসাধারণকে অবগত করতে পারেননি, রোগটা আসলে কি এবং প্রতিকার ও প্রতিরোধের উপায় কি। বিশেষ করে উখিয়া-টেকনাফে ছড়িয়ে পড়া অজানা ভাইরাসটির নাম এখনো শনাক্ত হয়নি। তবে শনাক্তকরণের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলমান রয়েছে বলে জানা গেছে।
টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলা থেকে জেলা ও শহরের হাসপাতালসমূহে আক্রান্ত রোগীরা আরোগ্য লাভের আশায় ছুটছেন। কিন্তু চিকিৎসার কিছুদিন যেতে না যেতেই আবারো আক্রান্ত হচ্ছেন বলে রোগী এবং স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা গেছে।
অনেকে বলছেন, রোগটি ভাইরাস জনিত রোগ। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির পানিশূন্যতা দেখা দেয়। সারা শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা অনূভব করে। মাত্রাতিরিক্ত জ্বরের পাশাপাশি হাঁড় ও বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যাথা দেখা দেয়। এ সময় অনেকের পা ফুলে যায়। মুখের রুচি নষ্ট হয়ে বমিবমি ভাব দেখা দেয়। রোগীর ঘুম হয় না। শরীর দুবর্ল হয়ে পড়ে। এছাড়া অনেক রোগীর মধ্যে এলার্জির লক্ষণও দেখা যায়।
চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, গত মে-জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে উখিয়া ও টেকনাফে এই রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। অনেকটা চিকনগুনিয়ার মত হলেও পরীক্ষা করে দেখা গেছে ৮০% চিকনগুনিয়ার লক্ষণ পাওয়া গেছে।
স্থানীয়রা বলছেন, উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার আশেপাশে এই রোগ বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও তৎসংশ্লিষ্ট এলাকায় কোন ঘর বাকি নেই, কম-বেশি সকলে এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। জ্বর ও ব্যথায় ছোট-বড় সকলে কাবু হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে আক্রান্ত শিশু এবং বৃদ্ধ বয়সের লোকজন বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছেন। শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেওয়ার সাথে সাথে শিশু ও বৃদ্ধ বয়সের লোকেরা একেবারেই দুর্বল হয়ে পড়ছেন।
আক্রান্ত স্থানীয় সংবাদকর্মী ফরিদুল আলম বলেন, মাত্রাতিরিক্ত জ্বর ও জয়েন্টে প্রচন্ড দেখা দিলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হই। চিকিৎসকের পরামর্শে ঔষুধ সেবনের কিছুদিন পর আবারো এ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ি। বর্তমানে জ্বর না থাকলেও ব্যথা নিয়ে কষ্টের মধ্যে আছেন বলে জানান তিনি।
লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্প ম্যানেজম্যান্ট কমিটির চেয়ারম্যান মো. আলম জানান, ক্যাম্পে প্রত্যেক ঘরের কম-বেশি সকলে ‘লুলা ব্যারাম’ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন। চিকিৎসা নেওয়ার সপ্তাহ খানিক পর আবারো একই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
হেল্থ এসিস্ট্যান্ড ও লাইফস্টাইল মেডিসিনের অভিজ্ঞ ডাক্তার মো. রশিদ আল মামুন জানান, রাতে ও দিনে মশারি টাঙ্গিয়ে ঘুমানোর অভ্যাস করতে হবে। বসতভিটা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন এবং খাবারে হাইজিন মেইনটেইনের উপর গুরুত্বারোপ করা উচিৎ। পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে জনবহুল স্থানে মাস্ক পরা দরকার। এছাড়া রাত না জেগে সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়ারও পরামর্শ দিয়েছেন এই চিকিৎসক।
টেকনাফ উপজেলা কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. এনামুল হক জানান, প্রতিদিন শত শত জ্বরের রোগী হাসপাতালে আসছে। পরিক্ষা করলেও রোগ শনাক্ত করা যাচ্ছে না।
টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. প্রণয় রুদ্র জানান, গত কোরবানীর ঈদের সময়ে টেকনাফে আচমকা এই রোগ দেখা দেয়। জুন মাসে ঢাকা থেকে একটা টিম এসে ২০ জনের স্যাম্পল নেন। স্যাম্পল পরীক্ষা করে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি।
তিনি আতংকিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষুধ সেবন করলে ৭/৮ দিন পর এই রোগ ভাল হয়ে যাবে। তাছাড়া ইতিমধ্যে রোগটি শনাক্তকরণে বা নাম নির্ণয়ে স্যাম্পল সংগ্রহ করে ঢাকার গবেষণাগারে পাঠানো হয়েছে। অতিশীঘ্রই এই ভাইরাসের নাম শনাক্ত করা হবে।
কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক সংক্রামণ রোগ ও ট্রপিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. শাহজাহান নাজির জানান, আইসিডিডিআরবিতে কক্সবাজার থেকে ২০০ স্যাম্পল পাঠানো হয়েছিল। প্রদত্ত স্যাম্পল পরীক্ষা এবং বিশ্লেষণে ৮২% চিকনগুনিয়ার লক্ষণ পাওয়া যায়। তাই এটি চিকনগুনিয়া জানিয়েছেন এই বিশেষজ্ঞ ডাক্তার।
তিনি আতংকিত না হয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়া প্রচুর পরিমাণে পানি পান এবং প্রয়োজন মতো প্যারাসিটামল সেবনের পরামর্শ দিয়েছেন।
জানা গেছে, এ অঞ্চলে বর্তমানে ৪ ধরনের জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের মাঝে জ্বরের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। এই জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে উচ্চমাত্রার জ্বর, অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যথা, কখনো ফুলে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। অনেক সময় জ্বর সেরে গেলেও কয়েক সপ্তাহ বা মাসব্যাপী জয়েন্টের ব্যথা থেকে যাচ্ছে।
বর্তমানে চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু, সাধারণ ভাইরাস জ্বর (ফ্লু) ও করোনা ভাইরাসজনিত জ্বর এই ৪টি জ্বরের প্রকোপ রয়েছে। প্রায় প্রতিটি এলাকায় রয়েছে জ্বরের রোগী। জ্বরের সঙ্গে জয়েন্টে ব্যথা, হাড় ফুলে যাওয়া, র্যাশ এসব উপসর্গ থাকলে চিকুনগুনিয়ার আশঙ্কা বেশি।
মূলত ভাইরাসটির উৎপত্তি থাইল্যান্ড, মালেশিয়া ও মিয়ানমারে। মিয়ানমারে ভাইরাসটিকে ‘আলফা ওয়ান’ নামে শনাক্ত করা হয়েছে।
কাঁচা সাপ চিবিয়ে খেলেন সাপুড়ে
ফিরছে চিকুনগুনিয়া, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কতা
ডেঙ্গু ও করোনা চিকিৎসায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নতুন নির্দেশনা
তিস্তা পারে বন্যার শঙ্কা