ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের কর্মসংস্থান

আপডেট : ০২ আগস্ট ২০২৫, ১২:৪৩ এএম

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় বর্তমানে ১১০টি বেসরকারি ও ৫৫টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যেখানে মোট প্রায় ১০ লাখ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পুরো শিক্ষাক্ষেত্র বিবেচনায় নিলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ কোটিরও বেশি। তবে শিক্ষা থেকে কর্মজীবনে রূপান্তরের এই যাত্রাপথে রয়েছে বেশ কিছু কাঠামোগত ও নীতিগত চ্যালেঞ্জ, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রায় ৩০% ড্রপআউট হার এবং স্নাতকদের মধ্যে ৩৫% বেকারত্ব। প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে, যা চাকরির বাজার এবং রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করছে।

বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা সাধারণত বিসিএস, শিক্ষা ও গবেষণা, এনজিও ও উন্নয়ন খাত এবং প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগীয় সেবায় ক্যারিয়ার গড়ে তোলে। এই শিক্ষার্থীরা মূলত দীর্ঘদিনের একাডেমিক ঐতিহ্য, শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিতি এবং শক্তিশালী অ্যালামনাই নেটওয়ার্কের কারণে সরকারি পেশায় বেশি সফল হন। অনেকেই ব্যাংক, বীমা প্রতিষ্ঠান ও আধা-সরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ পান। তবে স্নাতকের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিযোগিতা দিন দিন তীব্র হচ্ছে। অধিকাংশ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম এখনও যথাযথভাবে আধুনিক প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং বাজার উপযোগী প্রস্তুতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অন্যদিকে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি এবং আইইউবি’র মতো ঢাকাভিত্তিক আরো কিছু উল্লেখযোগ্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মূলত কর্পোরেট, মিডিয়া, বিজ্ঞাপন, বহুজাতিক সংস্থা ও উন্নয়ন খাতে প্রবেশ করে। এমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আধুনিক ক্যারিয়ার সার্ভিস সেন্টার, ইন্টার্নশিপ সুবিধা ও গ্রুমিং ওয়ার্কশপের কারণে শিক্ষার্থীরা সফট স্কিল, ইংরেজি দক্ষতা এবং ব্যক্তিত্ব গঠনে এগিয়ে থাকে, যা তাদের চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতামূলক করে তোলে। অনার্স পর্যায়ে ইংরেজি সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি পড়া শিক্ষার্থীরাও এখন ডিজিটাল মার্কেটিং, এইচআর, ইউআই/ইউএক্স, টেকনিক্যাল রাইটিং ও কনটেন্ট ক্রিয়েশন–এ কাজ করছে। এছাড়া ফ্রিল্যান্সিং, রিমোট কাজ এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কনটেন্ট তৈরি, কাস্টমার সার্পোট ও গ্রাফিক ডিজাইনেও কর্মসংস্থানের দরজা খুলেছে।

তবে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও একটি সাধারণ চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তা হলো- শিক্ষা ও কর্মজীবনের মধ্যে স্পষ্ট ব্যবধান।  সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী, সীমিত শিক্ষক, ও পুরনো পাঠক্রম শিক্ষার গুণগত মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবহারিক দক্ষতা শেখানোর ওপর জোর থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই তাত্ত্বিক গভীরতা ও গবেষণা দুর্বল।

মূল চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে- ইংরেজি ভাষায় দুর্বলতা, ডিজিটাল দক্ষতার ঘাটতি, সফট স্কিলের অভাব এবং কেবল ডিগ্রি নির্ভরতায় কর্মজীবনে ব্যর্থতা। ফলে অনেকেই তাদের বিষয়ভিত্তিক কাজ না পেয়ে কল সেন্টার, খুচরা ব্যবসা কিংবা বিপণনে চাকরি করতে বাধ্য হন।

ভৌগোলিক অবস্থানও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকাকেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেখানে ক্যারিয়ার মেলা, কর্পোরেট সংযোগ ও চাকরির সুযোগে এগিয়ে, সেখানে প্রান্তিক বা গ্রামীণ এলাকায় অবস্থিত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকরা সাধারণত স্থানীয় স্কুল-কলেজ, কোচিং সেন্টার, এবং শিক্ষা ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে চাকরি করেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চলে আসে বিপণন, কাস্টমার রিলেশনশিপ, ব্যবসা উন্নয়ন ও আউটসোর্সিং খাতে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নারী শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ, নমনীয় এবং আধুনিক পরিবেশ তৈরি করায় নারীর কর্মসংস্থানে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। এছাড়া বাংলাদেশে বর্তমানে ৩০০০-এর বেশি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে, যা দেশের একাডেমিক বৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করছে। টেলিভিশন, সিনেমা, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম, ডিজিটাল কনটেন্ট, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও বিজ্ঞাপন শিল্পে বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকরা কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত খুলছেন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করছে।

বর্তমানে চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ডিগ্রির নামের পরিবর্তে প্রকৃত দক্ষতাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তারা এখন অ্যাপটিটিউড টেস্ট, কেস স্টাডি ও প্রোবেশন পিরিয়ড ব্যবহার করে প্রার্থীদের বাস্তব সক্ষমতা যাচাই করছে। ফলে যারা ইন্টার্নশিপ, সার্টিফিকেট কোর্স, ফ্রিল্যান্সিং বা উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করছে, তারা বেশি সফল হচ্ছে। সরকারের ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট পলিসি (NSDP) ও ইয়ুথ এমপ্লয়মেন্ট প্রোগ্রাম কর্মমুখী শিক্ষা নিশ্চিত করতে কাজ করছে। এই প্রকল্পগুলো ডিজিটাল প্রশিক্ষণ, সফট স্কিল উন্নয়ন, স্টার্টআপ ইনকিউবেশন-এ সহায়তা করছে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫৫ শতাংশের বেশি প্রাথমিক পর্যায়ে থাকায়, তাদের প্রযুক্তিগত ও মৌলিক দক্ষতায় বিনিয়োগ করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষায় সমান গুরুত্ব দিলেই ভবিষ্যতে একটি প্রযুক্তিনির্ভর, দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে উঠবে।

ব্যবসায় প্রশাসন, অর্থনীতি, ইংরেজি ইত্যাদি জনপ্রিয় বিষয়ের স্নাতকদের অতিরিক্ত সংখ্যায় বাজারে চাহিদা কমে গেছে, ফলে প্রতিযোগিতা তীব্র হচ্ছে। হ্যান্ডস-অন ট্রেনিং, একাধিক ইন্টার্নশিপ ও ভাষাজ্ঞান- এই সবই এখন চাকরি পাওয়ার মূল শর্ত হয়ে উঠেছে। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যারিয়ার সাপোর্ট ইউনিট শক্তিশালী, তারা স্নাতকদের ভালোভাবে বাজারে প্রবেশ করাতে পারছে। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয় এখনও অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীর জন্য একটি বড় বাধা। এই ব্যবধান দূর করতে শিল্প ও একাডেমিয়ার মধ্যে সহযোগিতা, বাস্তবভিত্তিক শিক্ষা ও মেন্টরশিপ আরও জোরদার করা জরুরি। অনেক স্নাতক এখন স্টার্টআপ ও সামাজিক উদ্যোক্তাবাদে প্রবেশ করছে। সরকারি নীতিমালাও এই পরিবর্তনকে গ্রহণযোগ্য করতে অর্থায়ন, প্রশিক্ষণ ও ইনকিউবেশন সুবিধা আরও সম্প্রসারণ করতে হবে। নারী স্নাতকরা বর্তমানে শিক্ষা, প্রশাসন, কর্পোরেট যোগাযোগ, এই ৩ ক্ষেত্রেই শক্ত অবস্থান তৈরি করছেন।

বিদেশে পড়ালেখা করে ফেরা শিক্ষার্থীরা দেশে নতুন চিন্তাধারা ও বৈচিত্র্য যোগ করছেন। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই নেটওয়ার্ক, সরকার ও প্রশাসনে চাকরির ক্ষেত্রে সহায়ক। অন্যদিকে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনরা কর্পোরেট, উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় আধিপত্য তৈরি করছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভিত্তিক পাঠক্রম আন্তর্জাতিক স্কলারশিপ ও রিমোট চাকরিতে সফলতার অন্যতম কারণ। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকরা একাডেমিক গবেষণা, সাংবাদিকতা, নীতিনির্ধারণ ও আইন পেশায় বিশেষ দক্ষতা অর্জন করছে। 

বর্তমানে এমন এক নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠছে, যারা প্রচলিত শিক্ষা ও প্রযুক্তিভিত্তিক দক্ষতা মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে অনেকে ক্ষুদ্র ব্যবসা, এনজিও বা শিক্ষা কার্যক্রমে নিজেকে নিয়োজিত করে সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।

আগামী দিনের চাকরি কেবল চাকরি নয়, বরং সমস্যা সমাধান, বিশ্লেষণ, মানিয়ে নেওয়ার দক্ষতা ও সৃজনশীলতায় নির্ভর করবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোডিং, তথ্য বিশ্লেষণ ও ডিজিটাল মার্কেটিং এখন আর শুধু আইটি নয়, বরং সব বিষয়ের শিক্ষার্থীর জন্য জরুরি হয়ে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অবশ্যই আধুনিক পাঠ্যক্রম, ইন্ডাস্ট্রি পার্টনারশিপ ও ইন্টার্নশিপ ভিত্তিক শিক্ষা চালু করতে হবে। উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণকে শিক্ষা কাঠামোর কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসতে হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব (4IR)-এর সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থা না মেলাতে পারলে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। ভবিষ্যতের স্নাতকদের হতে হবে বিশ্বমানের দক্ষতা, দায়িত্ববোধ ও নেতৃত্বগুণে সমৃদ্ধ।

সামগ্রিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো সরকারি চাকরি ও গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছে, আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তৈরি করছে কর্পোরেট, উন্নয়ন ও প্রযুক্তি খাতের নতুন প্রজন্ম। সম্প্রতি বেসরকারি কয়েকটি  বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি গবেষণায় এবং রাঙ্কিং এ খুবই ভালো করছে। বেকারত্ব, দক্ষতার ঘাটতি, ও সম্পদের বৈষম্য সবখানে বিদ্যমান থাকায় তরুণদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে একটু বেগ পেতে হচ্ছে। তাই তরুণদেরকে আধুনিক পাঠ্যক্রম, দক্ষতা উন্নয়ন, নীতিগত সংস্কার ও উদ্যোক্তা সহায়তা  প্রদান খুবই জরুরি। সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার উন্নয়নের মাধ্যমেই কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে অর্থনীতির ব্যাপক ব্যবধান ঘুচিয়েই বাংলাদেশ হতে পারে জ্ঞানভিত্তিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির শক্তিশালী এক রাষ্ট্র।  

লেখক: নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-পরিচালক

আরও পড়ুন