জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা লেখক রকিব হাসান আর নেই। রকিব হাসান ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। তার দুটি কিডনিই বিকল হয়ে গিয়েছিল।
বুধবার (১৫ অক্টোবর) বিকেলে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রকিব হাসানের (৭৫) মৃত্যুর খবরটি জানিয়েছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মূর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মূর হোসেনের স্ত্রী।
রকিব হাসানের বড় ছেলে রাহিদ হাসান জানান, তার বাবা লেখক রকিব হাসান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালে ডায়ালাইসিস ইউনিটে নিয়মিত চিকিৎসাসেবা নিচ্ছিলেন। বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতার পাশাপাশি দুটি কিডনি বিকল হয়ে গিয়েছিল তার।
রাহিদ হাসান আরও জানান, সপ্তাহে দুই দিন নিয়মিত ডায়ালাইসিস নিতে হতো তার। আজ বুধবার ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া হঠাৎই বন্ধ হয়ে গেলে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি।
পড়ুয়াদের কৈশোরের সঙ্গী তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা ১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। তবে বাবার চাকরির সুবাদে তার ছোটবেলা কাটে ফেনীতে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে মন টেকেনি এই লেখকের। অবশেষে তিনি লেখালেখিকেই বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে। নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম।

রকিব হাসানের প্রথম বই প্রকাশিত হয় ছদ্মনামে, ১৯৭৭ সালে। স্বনামে প্রথম প্রকাশ অনুবাদগ্রন্থ 'ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা' দিয়ে। তিনি আরও অনুবাদ করেছেন এরিক ফন দানিকেন, ফার্লে মোয়াট, জেরাল্ড ডুরেলের মতো বিখ্যাত লেখকদের ক্লাসিক বই। অনুবাদ করেছেন অ্যারাবিয়ান নাইটস ও এডগার রাইস বারোজের টারজান সিরিজ।
রকিব হাসান নামটা যেভাবে এল
রকিব হাসানের ছদ্মনাম জাফর চৌধুরী, আবু সাঈদ। আবুল কাসেম আবদুর রকিব। এই নামকেই কাটছাট করে রাখা হয় 'রকিব হাসান'।
আবু সাঈদ ছদ্মনামে বের হয় গোয়েন্দা রাজু সিরিজ। আর জাফর চৌধুরী নামে লেখেন রোমহর্ষক সিরিজ। ১৬টা বই বের হয়েছিল গোয়েন্দা রাজু সিরিজের। উল্লেখযোগ্য বই- মামার মন খারাপ, চকলেট রহস্য, দামি কুকুর...ইত্যাদি। রোমহর্ষক সিরিজের উল্লেখযোগ্য বই- যাও এখান থেকে, নরবলি, পাগলা ঘন্টি, অভিশপ্ত ছুরি ইত্যাদি। এই সিরিজের মোট বই বেরিয়েছিল ১১টা।
রকিব হাসান নামের পেছনে একটি মজার ঘটনা আছে বলে জানিয়েছিলেন তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা। বলেছিলেন, তার সার্টিফিকেট নামটা বিশাল। আবুল কাশেম মোহাম্মদ আবদুর রকিব-পাঁচটা নামের সমাহার।
রকিব হাসান ছদ্মনামের বাইরে সেবায় শামসুদ্দীন নওয়াব এবং কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে বই লিখেছেন। রকিব হাসানের নামে বের হওয়া বইটি ছিল একটা অনুবাদ: জঙ্গল, ক্যানেথ অ্যান্ডারসনের শিকার কাহিনি। এই বইয়ের পাণ্ডুলিপি তিনি জমা দিয়েছিলেন আবদুর রকিব নামে। তখন বিচিত্রা পত্রিকার সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী সেবা প্রকাশনীর বেশির ভাগ বইয়ের প্রচ্ছদ করতেন। প্রচ্ছদ করতে গিয়ে তিনি আবদুর রকিব নাম নিয়ে আপত্তি তোলেন। নামটা পছন্দ হয়নি তার।
দিন তিনেক পর কাজী আনোয়ার হোসেন ডেকে পাঠালেন। শাহাদত চৌধুরীও ছিলেন। তিরি রকিব হাসানকে চমৎকার একটি যে প্রচ্ছদ দেখালেন। সেখানেই কাজী আনোয়ার হোসেনের সম্মতিতে জন্ম হলো 'রকিব হাসান' নামের। আবদুর রকিবের সঙ্গে তার ডাকনাম হাসান জুড়ে করা হলো রকিব হাসান। রকিব হাসান নামেই বই হিট হয়ে গেল। দ্বিতীয় বইও বের হয়ে ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা- সুপারহিট!
ছোটদের জন্য লিখেই রকিব হাসান অধিক খ্যাতি পেয়েছে। তিন গোয়েন্দা ছাড়াও তার অন্য দুটি সিরিজ তিন বন্ধু ও গোয়েন্দা কিশোর মুসা রবিন। তার তিন গোয়েন্দা সিরিজের মোট বইয়ের সংখ্যা ১৬০। অনুবাদ করেছেন ৩০টি বই। বড়দের উপযোগী তার লেখা কিছু রহস্য উপন্যাসও জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
রকিব হাসানের রোমহর্ষক সিরিজে রেজা ও সুজা দুই ভাইয়ের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। এই সিরিজটি থেকে তিন গোয়েন্দায় অনেকগুলো গল্প ভিন্ন নামে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া কিশোরদের জন্য বেশ কিছু সায়েন্স ফিকশনও লিখেছেন তিনি। রকিব হাসান কেবল তিন গোয়েন্দারই ১৬০টি বই লিখেছেন। এছাড়া কমপক্ষে ৩০টি বই অনুবাদ করেছেন।
চাকরির চেয়ে লেখালেখিই ভালো লেগেছিল
রকিব হাসান চাকরি করেছেন প্রায় ১২-১৩টি। কোথাও ৮ ঘণ্টা, কোথাও ২০ ঘণ্টা। কোনো চাকরিই টেকেনি বেশি দিন। তাঁর মতে, ‘বসের ঝাড়ি আমার সহ্য হবে না, স্যার বলতে পারব না, সালাম দিতে পারব না… আমি স্বাধীন টাইপের মানুষ।’
সেবা প্রকাশনীর সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক
পল্টনের পুরনো বইয়ের দোকানে হঠাৎ একদিন পরিচয় হয় মাসুদ রানার আরেক লেখক শেখ আবদুল হাকিমের সঙ্গে। তিনি রকিব হাসানের বিদেশি থ্রিলার গোয়েন্দা কাহিনি পড়ার অভিজ্ঞতা শুনে মুগ্ধ হন। তিনি কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করেন। সপ্তাহখানেক পরে মাসুদ রানার প্লট নিয়ে হাজির হন সেগুনবাগিচার সেবা প্রকাশনীতে। শুরু হলো সেবায় পথচলা।
রকিব হাসান কেবল নাম নন, এক অনুভব
তিন গোয়েন্দা তাঁর হাত ধরে কেবল একটি সিরিজ নয়, হয়ে উঠেছে এক প্রজন্মের কল্পনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। পাঠকের মনে রয়ে যাবে রকিব হাসান- একজন লেখক যিনি শুধু গল্প বলেননি, সৃষ্টি করেছেন এক অনন্য জগৎ।
তাঁর মৃত্যুতে কিশোর সাহিত্যে শূন্যতা তৈরি হলো যা সহজে পূরণ হবার নয়। বিদায়, তিন গোয়েন্দার রূপকার।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, আজ এশার নামাজের পর শাহজাহানপুর কবরস্থানে রকিব হাসানের মরদেহ দাফন করা হবে।
‘তিন গোয়েন্দা’ সিরিজের রকিব হাসান আর নেই