ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

ধর্ম কীভাবে মানসিক শান্তি প্রদান করে

আপডেট : ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ০২:৫৯ পিএম

মানসিক শান্তি মহান আল্লাহর এক অমূল্য নেয়ামত। এটি অর্থ-সম্পদ, খ্যাতি বা পারিবারিক প্রাচুর্য দিয়ে অর্জন করা যায় না। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে, প্রকৃত প্রশান্তি আসে আল্লাহর স্মরণ, তাঁর ওপর ভরসা এবং নিয়মিত ধর্মীয় চর্চার মাধ্যমে। ধর্মীয় জীবন শুধু আখেরাতের মুক্তির পথ নয়, বরং দুনিয়ার জীবনেও মানসিক স্থিরতা ও সুখের গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

তাই প্রকৃত মানসিক শান্তি লাভের পথ একটাই আল্লাহর স্মরণ, তাঁর প্রতি ভরসা এবং ধারাবাহিক ধর্মীয় চর্চা।

আল্লাহর জিকির: অন্তরের খাদ্য

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘জেনে রাখো, আল্লাহর স্মরণেই হৃদয়সমূহ প্রশান্তি লাভ করে।’ (সুরা রাদ: ২৮)

জিকির শুধু জিহবা নড়ানোর নাম নয় এ হলো অন্তরের এক গভীর সংযোগ, এক নীরব আলাপন আল্লাহর সঙ্গে। তাফসিরবিদদের ব্যাখ্যায়, জিকিরের পরিসর বিস্তৃত; এর মধ্যে রয়েছে নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, তাসবিহ, দোয়া ও নফল ইবাদত। এই স্মরণগুলো আত্মার পুষ্টি জোগায়, অস্থিরতার অন্ধকারে জ্বেলে দেয় প্রশান্তির আলো। হৃদয় যখন সৃষ্টিকর্তার স্মরণে ভরে ওঠে, তখন দুনিয়ার ভয়, উদ্বেগ ও ক্লান্তি মুছে যায় এক অপরূপ শান্তির স্রোতে।

নামাজ: প্রশান্তির উৎস ও চক্ষুশীতলকারী

রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘নামাজে রাখা হয়েছে আমার চক্ষুর শীতলতা।’ (নাসায়ি: ৩৯৩৯; মেশকাত: ৫২৬১)

যারা বিশুদ্ধ ঈমান, খুশু ও মহব্বত নিয়ে নামাজে দাঁড়ায়, তাদের মন স্বস্তিতে ভরে ওঠে। নবীজি (স.) যখন দুঃখ বা উদ্বেগে পড়তেন, তিনি নামাজে আশ্রয় নিতেন। নামাজ আত্মাকে স্থির করে, চিন্তা ও ভয় দূর করে এবং মানুষকে আল্লাহর নিকটে নিয়ে যায়।

আল্লাহর ওপর ভরসা (তাওয়াক্কুল): ভয়ের ঊর্ধ্বে জীবন

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে, আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট।’ (সুরা তালাক: ৩)

মানুষের বেশির ভাগ মানসিক অশান্তি আসে ভয় থেকে অভাবের ভয়, হারানোর ভয়, ভবিষ্যতের ভয়। অথচ যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা স্থাপন করে, সে জানে তার রিজিক ও ভবিষ্যৎ আল্লাহর হাতে।

রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘তোমরা যদি প্রকৃতভাবেই আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল হতে তাহলে পাখিদের যেভাবে রিজিক দেয়া হয় সেভাবে তোমাদেরকেও রিজিক দেয়া হতো। এরা সকালবেলা খালি পেটে বের হয় এবং সন্ধ্যায় ভরা পেটে ফিরে আসে।’ (তিরমিজি: ২৩৪৪)

সদাচরণ ও হাস্যোজ্জ্বল আচরণ: সামাজিক প্রশান্তির চাবিকাঠি

নবীজি (স.) বলেছেন, ‘তোমার হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা সদকার সমান।’ (তিরমিজি: ১৯৫৬)

মানুষের সঙ্গে সৌজন্যপূর্ণ আচরণ, হাস্যোজ্জ্বল মনোভাব ও সহানুভূতি মনের ভার হালকা করে। সমাজে ইতিবাচক ভাব তৈরি হয়, যা মানসিকভাবে প্রশান্তি আনে।

সদকা ও দান: অন্তরের প্রাচুর্যের উপায়

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা আল্লাহর পথে তাদের সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ এক বীজের মতো, যা উৎপন্ন করে সাতটি শীষ, প্রতিটি শীষে একশ শস্যদানা।’ (সুরা বাকারা: ২৬১)

সদকা মানুষকে স্বার্থপরতা থেকে মুক্ত করে, অন্তরে কৃতজ্ঞতা ও উদারতার বোধ জাগায়। এটি আত্মিক শান্তি, আর্থিক বরকত ও আল্লাহর সন্তুষ্টির পথ।

শুকরিয়া আদায়: অশান্তির প্রতিষেধক

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় করো, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেব; আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তবে আমার শাস্তি কঠিন।’ (সুরা ইবরাহিম: ৭)

সব পেয়েও অনেকে অশান্তিতে ভোগে। কারণ তারা কৃতজ্ঞ নয়। কৃতজ্ঞতা মানুষকে অভাবের মাঝেও তৃপ্তি শেখায়। তাই প্রশান্তির আসল রহস্য হলো ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলা শেখা।

আখেরাতকে প্রাধান্য: চিরস্থায়ী প্রশান্তির পথ

হাদিসে কুদসিতে বলা হয়েছে, ‘হে আদমসন্তান, তুমি যদি আমার ইবাদতে মগ্ন থাকো, আমি তোমার অন্তরকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করব এবং দারিদ্র্য দূর করব; তুমি যদি তা না করো, আমি তোমার অন্তরকে হতাশা দিয়ে পূর্ণ করব এবং দারিদ্র্য দূর করব না।’ (ইবনে মাজাহ: ৪১০৭)

যে ব্যক্তি দুনিয়ার লাভ-ক্ষতির ঊর্ধ্বে আখেরাতের চিন্তা করে, তার মন স্থির থাকে। দুনিয়ার ক্ষতি তাকে কষ্ট দেয় না, কারণ সে জানে তার প্রকৃত পুরস্কার আল্লাহর কাছে।

বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের আলোকে প্রমাণ

আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত নামাজ ও দোয়া স্ট্রেস হরমোন (কর্টিসল) কমায়। মনোযোগপূর্ণ ইবাদত মস্তিষ্কের প্রশান্তি কেন্দ্র সক্রিয় করে। ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্রার্থনা মানুষকে অর্থপূর্ণ জীবনের অনুভূতি দেয়, যা উদ্বেগ প্রতিরোধ করে। 

হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের এক গবেষণায় প্রমাণিত, যারা নিয়মিত প্রার্থনা বা ধর্মীয় ধ্যান করেন, তাদের মধ্যে মানসিক চাপ ও বিষণ্নতার হার উল্লেখযোগ্যভাবে কম। 

ধর্মীয় চর্চা শুধু আখেরাতের মুক্তির পথ নয়, বরং দুনিয়ার জীবনেও মানসিক প্রশান্তির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস। আল্লাহর স্মরণ, নামাজ, জিকির, সদকা, কৃতজ্ঞতা ও আখেরাতমুখী জীবন মানুষকে হতাশা থেকে রক্ষা করে এবং অন্তরে শান্তির বাগান গড়ে তোলে। ‘যে আল্লাহর সঙ্গে সংযুক্ত থাকে, সে কখনো একা নয়; তার অন্তরেই থাকে প্রশান্তির জান্নাত।’ হে আল্লাহ, আমাদের অন্তরকে প্রশান্ত করুন, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে আপনার সন্তুষ্টি অর্জনের পথে ব্যয় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

NB/AHA
আরও পড়ুন