চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী মানুষের জানমাল রক্ষায় ৩০০ কোটি টাকায় নির্মিত স্থায়ী বেড়িবাঁধে কোন রকম জলোচ্ছ্বাস ছাড়াই সিসি ব্লক ধসে সাগরে তলিয়ে গেছে। বাঁশখালীর খানখানাবাদের প্রেমাশিয়া এলাকায় ৯ দিন আগে বিশালকার এই বেড়িবাঁধ তলিয়ে যায়।
স্থানীয়দের দাবি, বেড়িবাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি ও নকশায় ত্রুটি থাকায় শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা বেড়িবাঁধটি বারবার ভেঙে তলিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে তলিয়ে যাওয়া বাঁধের আশেপাশে নতুন করে আবারও ফাটল সৃষ্টি হওয়ায় চরম আতঙ্কে দিন কাটছে এলাকাবাসীর।
জানা যায়, বাঁশখালী উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে ৯ বছর আগে প্রায় ২৫১ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। ২০১৫ সালের ১৯ মে প্রকল্পটি একনেকে পাস হয়। বঙ্গোপসাগর ও সাঙ্গু নদীর পাড়ে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই বাঁধ নির্মাণে কয়েক দফা সময় ও ব্যয় বেড়ে হয়েছিল ৩০০ কোটি টাকা।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকল্প শেষের আগেই খানখানাবাদের কদমরসুল এলাকায় এক কিলোমিটার সিসি ব্লক বেষ্টিত বেড়িবাঁধ পানির স্রোতে তলিয়ে যায়। ওই ঘটনার বছর যেতে না যেতেই গতকাল মধ্যে রাতে ওই জায়গার পার্শ্ববর্তী প্রেমাশিয়া এলাকায় বাঁধ রক্ষায় নির্মিত সিসি ব্লক বেষ্টিত আরও ২০০ মিটার বেড়িবাঁধ বঙ্গোপসাগরে তলিয়ে গেছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রেমাশিয়া এলাকার মৌলভী হাসান চেয়ারম্যানের বাড়ির সামনে সিসি ব্লক বেষ্টিত ২০০ মিটার বাঁধের ব্লক ধসে সাগরে তলিয়ে বিলীন হয়ে গেছে। যে জায়গায় তলিয়ে গেছে সেখানে বেড়িবাঁধ ক্ষয় রোধে লাগানো ব্লকের কোনো অস্তিত্বও নেই। বেশিরভাগ ব্লক ধসে তলিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের আশেপাশেও নতুন করে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে, যা যেকোন মুহুর্তে নতুন করে ধসে বঙ্গোপসাগরে তলিয়ে যেতে পারে।
পাউবো সূত্র জানায়, বাঁশখালীর বঙ্গোপসাগর উপকূল ও সাঙ্গু নদীর পাড়ে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প ২০১৫ সালের ১৯ মে একনেকে পাস হয়। যাতে ব্যয় ধরা হয় ২৫১ কোটি ২৯ লাখ টাকা। পরে কয়েক দফা প্রকল্পটির সময় ও ব্যয় বেড়ে হয় ২৯৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পের আওতায় এতে ৬.২ কিলোমিটার বাঁধের ঢাল সংরক্ষণ, ভাঙন রোধ ও পুনরাকৃতিকরণ, ৩.৮ কিলোমিটার নদীর তীর সংরক্ষণ ও ৫.৬ কিলোমিটার বাঁধ পুনরাকৃতিকরণ করা হয়।
ওই প্রকল্প শেষ হতে না হতেই ২০২৪ সালে ২৮ মে আবারও ৫০৪ কোটি টাকার প্রকল্প একনেকে পাস হয়। প্রকল্পে ৬.৪ কিলোমিটার সমুদ্র উপকূলবর্তী বাঁধের ঢাল সংরক্ষণ, ভাঙন রোধ, পুনরাকৃতিকরণ। যেটা ছনুয়া, খানখানাবাদ ও বাহারছড়া উপকূলের অংশে নির্মিত হবে। বাকি ১.১ কিলোমিটার নদীর তীর রক্ষায় সাধনপুর অংশের সাঙ্গু নদীতে বাঁধ নির্মিত হওয়ার কথা রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, বাঁধে নিম্নমানের কাজ ও নকশায় ত্রুটির কারণে আজ ২০০ মিটার বেড়িবাঁধ তলিয়ে ও ধসে পড়েছে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসেও খানখানাবাদের কদমরসুল এলাকায় এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ তলিয়ে গেছিল। মূলত কর্তৃপক্ষের চুরির কারণে বেড়িবাঁধ টেকসই হয় না। সাঙ্গু নদীর গতিপথ পরিবর্তন ও কম খরচে প্রকল্পের নকশার দায় এড়াতে পারেন না পাউবোর কর্মকর্তারা। বেড়িবাঁধ সংস্কারের নামে লুটপাট করেছে। যে প্রতিষ্ঠান লুটপাট ও নিম্নমানের নির্মাণ কাজে জড়িত ছিল, সেই হাসান ব্রাদার্সকে আবারও ৫০০ কোটি টাকার বেড়িবাঁধ প্রকল্পে কাজ দেওয়া হয়েছে। এসব জনগণের সাথে মশকরা ছাড়া কিছু নয়।
খানখানাবাদ প্রেমাশিয়া এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ হাসান ও শরিফুল ইসলাম বলেন, ৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ে আমরা সর্বস্ব হারিয়ে ফেলি। প্রতি বছরই বর্ষাকাল ও ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতীতে বাপ দাদার ভিটে-মাটি সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। একে একে ৪/৫ ঘরবাড়ি সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম বেড়িবাঁধের কারণে নতুন করে প্রাণ ফিরে পাব আমরা। কয়েকদফা বাঁধ তলিয়ে যাওয়ার কারণে ভয়ে আছি। সংস্কারের নামে নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে কাজ করে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, ঠিকাদার ও পাউবোর কর্মকর্তারা বাঁধের টাকা লুটপাট করেছে। যার কারণে বাঁধ টেকসই হয়নি।
খানখানাবাদ এলাকার বাসিন্দা বিএনপি নেতা মাস্টার লোকমান হাকিম বলেন, তলিয়ে যাওয়া বেড়িবাঁধে অনেক আগে থেকে ফাটল দেখতে পেয়ে বেশ কয়েকবার পাউবো কর্মকর্তাদের অবহিত করে এলাকাবাসী। তারা কোন ব্যবস্থা নেননি। তলিয়ে যাওয়া সিসি ব্লক বেষ্টিত বাঁধের আশেপাশে নতুন করে আরও ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। জরুরিভাবে সংস্কার করা না হলে বাঁধের আশেপাশের এলাকা লবণ পানিতে প্লাবিত হবে। আমরা এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে পাউবোকে দ্রুত বেড়িবাঁধ সংস্কারের দাবি জানাই।
খানখানাবাদ ইউপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম বলেন, বেড়িবাঁধ তলিয়ে যাওয়ার পর পরই বিষয়টি আমি পাউবো কর্মকর্তাদের অবহিত করেছি। আমি নিজেও পরিদর্শন করেছি। তলিয়ে যাওয়া বাঁধের আশেপাশে আরও ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। দ্রুত কাজ করা না হলে আশেপাশের বাঁধও ধসে যাবে। সামনে কার্তিক মাসের জোয়ার ও ঘুর্ণিঝড় রয়েছে। তার আগেই বাঁধ সংস্কার করা না হলে লবণ পানিতে ধ্বংস হয়ে যাবে প্রেমাশিয়া এলাকার শত শত একর কৃষিজমি ও ধানক্ষেত।
পাউবোর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী অনুপম পাল বলেন, ধসে যাওয়া সিসি ব্লক বেষ্টিত বাঁধটি পরিদর্শন করেছি আমরা। ওই জায়গায় এখন জিওটিউব বসানো হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধটি সার্ভে করার পর জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হবে। আশা করি, নতুন করে বেড়িবাঁধ ভেঙে ওই এলাকা প্লাবিত হবে না। বাঁধের বিপরীতে একটি চর সৃষ্টি হওয়ায় সাঙ্গু নদীর গতিপথ পাল্টে বেড়িবাঁধে আঘাত করছে। ফলে বাঁধ ধসে যাচ্ছে।